শ্রীশ্রী তারক চাঁদ চরিত্র সুধা মাতা পিতার বন্দনা পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম সর্ব শাস্ত্রে কয়। ভাবিয়া পিতার পদ রাখিনু মাথায়।। যাহার কৃপায় আমি এ জগতে আসি। তাহার শরণে পাপ খণ্ডে রাশি রাশি।। না বুঝিয়া কত পাপ করেছি চরণে। এ পাপের নাহি ক্ষমা সে চরণ বিনে।। কত কষ্টে পিতা মোর করেছে পালন। পিতৃ ঋণ শোধ দিতে পারে কোন জন।। পিতা যে পরম বস্তু সাধনের ধন। পূঁজিলিনা সে চরণ ওরে মূঢ় মন।। মায়াজালে হয়ে বন্দি সে সব ভুলিলি। ঘরেতে রাখিয়া ধর বাহিরে খুঁজিলি।। যখনে ছিলিরে মন পিতৃ-মণি পুরে। তথা হতে আইলিরে জননী জঠরে।। দশ মাস দশ দিন ছিলি মাতৃগর্ভে। মাতা মোর কত কষ্ট করে কত ভাবে।। অসহ্য যাতনা মাতা সহে হাস্য মুখে। আশাতে বাঁধিয়া বুক সদা থাকে সুখে।। দশ মাস দশ দিন যখনে হইল। প্রসব করিতে মাতা কত কষ্ট পেল।। তারপর কতভাবে করেছে পালন। স্তন দুগ্ধ দিয়ে মোরে বাঁচায় জীবন।। তবু মাতা দিন রাত প্রফুল্ল-অন্তরে। স্নেহভরে কোলে করে কত যত্ন করে।। নিজে না খাইয়া মাতা খাওয়ায়েছে মোরে। মলমূত্র ধোঁয়ায়েছে ঘৃণা নাহি করে।। এত কষ্ট করে মাতা তবু হাসি মুখে। মা শব্দের তুল্য দিতে আর কিছু নাই। ঐ চরণে গয়া গঙ্গা সব কিছু পাই।। এহেন মায়ের পদ ভাবিয়া অন্তরে। লিখিলাম এই পুথি মা বাপের বরে।। মাতা পিতার চরণে করিলাম স্তুতি। পাপ দেহে যেন মোর জাগয়ে ভকতি।। তাই বলি ওরে মন হরি হরি বল। কান্দিয়া বিনোদ বলে বেলা ডুবে গেল।। শ্রীশ্রী হরিচাঁদ বন্দনা নম নম হরিচাঁন্দ পতিত পাবন। তব শ্রীচরণে মোর থাকে যেন মন।। সাধনা না জানি প্রভু ভজন না জানি। নিজ গুণে দাও তব চরণ দু’খানি।। তুমি হরি গুণনিধি জগতের সার। এ ভব সাগর হতে কর মোরে পার।। তোমার গুণের সীমা বর্ণিতে কি পারি। গুণের অতীত তুমি দয়াল শ্রীহরি।। তোমার ইশারাতে এ জগত চলে। তোমার মায়াতে প্রভু এ জগত ভোলে।। সত্য যুগে ছিলে তুমি নাম রূপ ধরি। ত্রেতা যুগে রাম রূপে জন্মিলেন হরি।। দ্বাপর যুগেতে প্রভু কৃষ্ণ অবতার। কলিতে গৌরাঙ্গ রূপে হইল প্রচার।। তারপর ওড়াকান্দি হলে অবতার। ঐ চরণে কোটি কোটি করি নমস্কার।। নম নম শান্তি মাতা জগত জননী। হরিচাঁদ প্রাণপ্রিয়া লোচন নন্দিনী।। চরণ যুগলে মাগো করি নিবেদন। দয়া করে অধমেরে দিও শ্রীচরণ।। হরি নাম প্রচারিতে হইলে প্রকাশ। অধমেরে কর প্রভু শ্রী চরণে দাস।। নমঃ নমঃ যশোমন্ত ঠাকুরের পিতা। নমঃ নমঃ অন্নপূর্ণা ঠাকুরের মাতা।। নমঃ নমঃ কৃষ্ণদাস প্রভু জ্যেষ্ঠ ভাই। চরণেতে কোটি কোটি প্রণাম জানাই।। নমঃ শ্রী বৈষ্ণব দাস অংশ অবতার। নমঃ নমঃ গৌরি দাস মহিমা অপার।। নমঃ শ্রী স্বরূপ দাস সবার কনিষ্ঠ। ঠাকুর চরণে যার ভক্তি একনিষ্ঠ।। নমঃ নমঃ শ্রীসুধন্য ধীর অবতার। নমঃ নমঃ শ্রীপতিচাঁদ তাহার কোঙর।। নমঃ নমঃ মঞ্জুলিকা মাতা ঠাকুরাণী। করপুটে বন্দি আমি চরণ দু’খানি।। নমঃ শ্রী প্রমথচাঁদ তুমি গুণমণি। নমঃ নমঃ বীণাপাণি মাতা ঠাকুরাণী।। নমঃ নমঃ অংশুপতি নমঃ শচিপতি। নমঃ শ্রীহিমাংশুপতি পদে করি স্তুতি।। ঠাকুর হইতে এল ঠাকুরের অংশ। করজোড়ে বন্দি আমি ঠাকুরর বংশ।। অধম বিনোদ বলে দিতে নারি সীমা। কৃপা করে অধমেরে করে দিও ক্ষমা।। ভক্তগণ বন্দনা নমঃ নমঃ হীরামন ভক্ত চূড়ামণি। নিজগুণে দাও তব চরণ দু’খানি।। নমঃ শ্রীগোলকচন্দ্র পাগল গোঁসাই। চরণেতে কোটি কোটি প্রণাম জানাই। নমঃ নমঃ শ্রীলোচন বড় দয়াময়। দয়া করে অধমেরে রাখ রাঙ্গা পায়।। নমঃ নমঃ মৃত্যুঞ্জয় সাধু শিরোমণি। দন্তে তৃণ ধরি বন্দি চরণ দু’খানি। (এখানে মনে হয় দু এক লাইন জ্ঞাপ হয়ে গেছে) তোমার কৃপাতে পাই অমূল্য রতন।। লীলামৃত গ্রন্থখানী শুধার মতন।। নমঃ নমঃ শ্রী অশ্বিনী প্রেমের মূরতি। যাহার কৃপাতে পাই হরিচাঁদ গীতি।। নমঃ নমঃ দশরথ পদ্মবিলা বাসি। ঠাকুরের নামে প্রেমে হইল উদাসী।। নমঃ নমঃ হরিপাল মহিমা প্রচুর। গহন বাদার মধ্যে দেখিল ঠাকুর।। নমঃ শ্রীগোপাল সাধু কি মধু পাইয়া। দক্ষিণ দেশ মাতাল হরিনাম দিয়া।। নমঃ নাটু, নমঃ ব্রজ, নমঃ বিশ্বনাথ। দিবানিশি থাকিতেন ঠাকুরের সাথ।। উদ্দেশ্য বন্দিনু আমি যত ভক্তগণে। অগণিত ভক্তবৃন্দ আছে যে যেখানে।। শ্রীশ্রী তারক চাঁদের জন্ম কথা হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ। তারকের জন্ম কথা করিব বর্ণন।। হরিচাঁদ ভক্ত তুমি তারক সুজন। আমার মস্তকে থাকি করিও লিখন।। সূর্য্যনারায়ণ ছিল ডুমুরিয়া গায়। লীলামৃতে লেখা আছে তার পরিচয়। সৃষ্টিধর নামে ছিল তাহার নন্দন।। হরিভক্ত মহাজ্ঞানী ছিল সেই জন। তিনি মোরে ভালবাসে পুত্রের সমান।। আমাদের বাড়ী তিনি আসিত যাইত। তারক চাঁদের কথা তিনি যে কহিত।। তার মুখে শুনিতাম এসব কাহিনী। তার আশির্বাদে হয় আমার লিখনী।। তারকের পিতা ছিল কাশীনাথ নামে। কালীভক্ত ছিল তিনি এই ধরাধামে।। মাথায় চিকন কেশ ছিল সুশোভন। চেহারায় দেখা যায় বেশ ষড়ানন।। কালীভক্ত শিরোমণি সরল হৃদয়। দিবা নিশি কালী নামে গাহিয়া বেড়ায়।। এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল। বিবাহ করিতে সবে তাহাকে কহিল।। কাশীনাথ দিল মত তার গুরুজনে। মেয়ে দেখিবারে গেল তাহাদের সনে।। কন্যা কর্তা মেয়ে এনে দেখাল তখন। অন্নদা নামেতে মেয়ে অতি সু-শোভন।। মেয়ে দেখে সকলের পছন্দ হইল। মেয়েটিকে ঘেরে যেতে আদেশ করিল।। অমনি অন্নদা দেবী প্রণাম করিয়া। সজল নয়নে গেল ঘরেতে চলিয়া।। ঘরে গিয়ে কাশীনাথ করে দরশন। অন্নদা হইল অতি আনন্দিত মন।। মস্তকের চুল দেখে আনন্দ পাইল। মনে মনে স্বামী রূপে বরণ করিল।। তারপর সবে মিলে বলিল বচন। কি ভাবে সমন্ধ হবে কর নির্ধারণ।। কন্যা কর্তা বলিলেন সকলের কাছে। বিষয় সম্পদ কিবা এ ছেলের আছে।। নিজ মুখে কাশীনাথ বলিল তখন। শুনিয়া কন্যার পিতা বিষাদিত মন।। বলিলেন এ সম্বন্ধ আমি করিব না। উচ্চ আশা আছে মোর মনের ধারণা।। তাই শুনে সবে মিলে কিছু না বলিল। জল পান করে সবে বিদায় হইল।। তাই শুনে সে অন্নদা অন্য বাড়ী গিয়ে। কাশিনাথে ডাকাইল অন্য লোক দিয়ে।। ঘরের মধ্যেতে নিয়ে বসিবারে দিল। ছল ছল আখি দু’টি কহিতে লাগিল।। শুন শুন শুন তুমি আমার বচন। চরণেতে করি আমি এক নিবেদন।। চুল যদি নাহি কাট কোনদিন তুমি। তব চরণেতে দাসী হয়ে রব আমি।। করজোড়ে এই কথা কহিল অন্নদা। ও চুলের যত্ন আমি করিব সর্বদা।। তাই শুনি কাশীনাথ কহিল তখন। এ সত্য করিয়া বলে মধুর বচন।। এই চুল কোন দিন কাটিব না আমি। পত্নী রূপে এই ভাবে হও যদি তুমি।। এই কথা বলে তিনি বিদায় হইল। প্রফুল্ল অন্তরে মেয়ে গৃহে চলে গেল।। তারপর সে অন্নদা পিতার নিকটে। ছল ছল আখি দু’টি বলে করপুটে।। শুন শুন শুন পিতা আমার বচন। এ ছেলের কাছে মোর সব সমর্পণ।। আমাকে করিতে সুখি তব ইচ্ছা পিতা। চিরসুখী হব আমি শুন মোর কথা।। অন্নদার পিতা শুনি এহেন বচন। মস্তকেতে হস্ত দিয়া কহিল তখন।। তোমার মনের বঞ্ছা আমি পুরাইব। জয়পুরে গিয়া আমি সম্বন্ধ করিব।। জয়পুরে গিয়া শেষে সম্বন্ধ হইল। কাশীনাথ অন্নদার মিলন ঘটিল।। অন্নদার মন বাঞ্ছা হইল পূরণ। কাশীনাথের হইল আনন্দিত মন।। দাম্পত্য জীবনে তারা হলো আনন্দিত। কালী মার চরণেতে ভকতি করিত।। এই ভাবে বহু দিন গত হয়ে গেল। অন্নদার গর্ভে কোন সন্তান না হল।। এই ব্যাথা নিয়ে তারা সংসার করিত। অন্নদাকে বন্ধ্যা বলে সকলে ভাবিত।। কাশীনাথ কবিগান শিক্ষা করি লয়। মাঝে মাঝে কবিগান গাহিয়া বেড়ায়।। সূর্য নারায়ণ ছিল দলের দোয়ার। অতি সুমধুর ছিল তার কণ্ঠস্বর।। এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল। মনের বেদনা তার মনেতে রহিল।। একদিন নৌকা যোগে কলিকাতা যায়। প্রতিবেশী তিন জন ছিল সে নৌকায়।। কলিকাতা গিয়ে তারা গঙ্গা স্নান করি। পাপদেহ জুড়াইয়া বলে হরি হরি।। পরেতে দক্ষিণেশ্বর কালীর মন্দিরে। মালা দিয়ে ভক্তি করে প্রফুল্ল অন্তরে।। মাতৃ ভক্ত কাশীনাথ করে তব স্তুতি। নয়ন জলেতে ভাসি দেখে মাতৃমুর্তি।। যখনেতে কাশীনাথ প্রণাম করিল। চুলের বাতাস মার অঙ্গেতে লাগিল।। তারপর সবে মিলে নৌকায় আসিল। যার যার কেনা বেচা সকলে করিল।। নৌকাতে আসিয়া সবে করিল ভোজন। সন্ধ্যা হল দেখে সবে কহিল তখন।। রাত্রি বেলা নৌকা বেয়ে যাব না কখন। ভোর বেলা নৌকা ছেড়ে করিব গমন।। নিদ্রা ঘোরে কাশীনাথ স্বপনে দেখিল। কালীমাতা এসে তার শিয়রে বসিল।। হাসি মুখে কালী মাতা কহিল তখন। শুন শুন কাশীনাথ আমার বচন।। তোমার চুলের বাও লাগে মোর গায়। তাহাতে হইল মোর প্রফুল্ল হৃদয়।। চুল কেটে দিয়ে যাও শুন বাছাধন। মম বাক্য কভু তুমি কর না লঙ্ঘন।। চোমর করিয়া তুমি হাতে দিয়া যাও। দিবা নিশি তব চুলে লব আমি বাও।। কাশীনাথ বলে মাগো আমি চুল নাহি দিব। কোন মতে এই চুল আমি না কাটিব।। কালীমাতা বলে তুই ছারে খারে যাবি। চুল যদি নাহি দিবি পরাণে মরিবি।। কাশীনাথ বলে মাগো তোমারে জানাই। পরাণ তেজিতে মোর কোন চিন্তা নাই।। সত্য ভঙ্গ করিবারে আমি না পারিব। সত্য রক্ষা করিবারে পরাণ তেজিব।। তাই শুনে কালীমাতা অদৃশ্য হইল। নিদ্রা থেকে কাশীনাথ জাগিয়া উঠিল।। একি আজি দেখিলাম ঘুমের ঘরেতে। ভয়েতে আকুল প্রাণ লাগিল কাঁপিতে।। অকস্মাৎ ভেদবমি হইল তাহার। মল ত্যাগ করিলেন দুই তিন বার।। এই ভাবে কলেরায় মৃত পায় হল। মা মা বলিয়া কাশী ডাকিতে লাগিল।। কেন্দে বলে ওগো মাতা বলি তব ঠাই। তোমার চরণ বিনে অন্য গতি নাই।। তোমার সেবক আমি তব নাম লই। এই বুঝি মরিলাম ওগো ব্রহ্মমই।। এই ভাবে কাশীনাথ কান্দিতে লাগিল। শেষ রাত্রে কালীমাতা নৌকাতে আসিল।। স্বরূপেতে দেখা দিয়ে কহিল তখন। শুন শুন কাশীনাথ আমার বচন।। সত্য করিয়াছ তুমি রমনীর ঠাই। সেই জন্যে তার গর্ভে পুত্র কন্যা নাই।। চুল যদি কেটে যাও আমার গোচরে। সেই গর্ভে এক পুত্র হবে মম বরে।। ব্যাসদেব জন্ম লবে এসে তব ঘরে। সার গ্রন্থ লিখে যাবে এই ধরা পরে।। এত বলি কালীমাতা হল অন্তর্ধান। তাই দেখ কাশীনাথ হারাইল জ্ঞান।। ক্ষণেক চেতনা পেয়ে কান্দিতে লাগিল। ধীরে ধীরে নৌকা হতে কুলেতে নামিল।। ক্ষৌরকার দিয়ে চুল কাটিল তখনে। চোমর করিয়া দিল মায়ের চরণে।। কেন্দে কেন্দে কাশীনাথ প্রণাম করিল। নয়নের জলে বক্ষ ভাসিতে লাগিল।। তার পরে ধীরে ধীরে নৌকায় আসিয়া। ভাগীদের কাছে সব কহিছে কান্দিয়া।। শুনিয়া সবাই তাই আশ্বর্চ্য হইল। কালীমার প্রীতে সবে হরিধ্বনি দিল।। তার পর সবে মিলে আনন্দ হৃদয়। কালী কালী বলি সবে তরী খুলে দেয়।। আনন্দেতে সবে মিলে তরণী বাহিল। তিন দিন পরে তরী ঘাটেতে আসিল।। তরী হতে নেমে সবে গৃহেতে চলিল। সবাকার কাছে সব ঘটনা জানা’ল।। শুনিয়া সকলে তাই আনন্দ হৃদয়। কালীমার প্রীতে সবে হরিধ্বনি দেয়।। এই ভবে কতদিন গত হয়ে গেল। কিছু দিন পরে দুর্গা পূজা করেছিল।। বড় আশা কাশীনাথ করে মনে মনে। বুক চিরে রক্ত দিল মায়ের চরণে।। সে সব বৃতান্ত লীলামৃতে লেখা আছে। নিজ হাতে শ্রী তারক তাহা লিখিয়াছে।। লক্ষ দূর্গা নাম বট পত্রেতে লিখিয়া। পূজা করে ভবানীর কান্দিয়া কান্দিয়া।। অন্নদার মন বাঞ্ছা হইল পূরণ। কিছু দিন পরে হইল গর্ভের লক্ষণ।। সেই গর্ভে জন্ম নিল তারক সুজন। সবাকার মন বাঞ্ছা হইল পূরণ।। অগ্রহায়ণ মাসেতে শনিবার দিনে। অমাবস্যা তিথী তাহে জন্মে শুভক্ষণে।। তারকের জন্ম ক্ষণে হেন জ্ঞান হয়। আকাশে বাতাসে যেন হরিগুণ গায়।। জয়ধ্বনি উলুধ্বনি করে বামাগণে। আনন্দে মাতিল সবে হরিগুণ গানে।। এ দীন বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে। হরিচাঁদ ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।। তাই বলি ভাই সব বেলা বেশি নাই। হরিচাঁদ প্রিতে সবে হরিবল ভাই।। ব্যাস মুনিই শ্রী তারক হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ। তারকের পূর্ব কথা করিব বর্ণন।। ভাগবত পুরাণাদি লিখে ব্যাসমুনি। ভাগবতে লেখা আছে এসব কাহিনী।। একদা নারদ মুনি আসিল ধরায়। ব্যাসের আশ্রমে এসে হইল উদয়।। ব্যাস মুনি দেখিলেন গুরু আগমন। ব্যাস্ত হয়ে ব্যাস মুনি করিল যতন।। আসনে বসায়ে মুনি ধোয়ায় চরণ। ভক্তি গদ গদ চিত্ত ঝরে দু’ নয়ন।। কান্দিতে লাগিল ব্যাস পড়িয়া ধরায়। নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।। নারদ বলিল ব্যাস কান্দ কি কারণ। তব মনে কিবা দুঃখ বল বাছাধন।। গুরু বাক্য শুনে কানে ব্যাস তপধন। করজোড়ে কহিতেছে মধুর বচন।। তোমার কৃপায় আমি এ জগতে আসি। বহু গ্রন্থ লিখিলাম আশ্রমেতে বসি।। চৌদ্দ খানি শাস্ত্র লিখি আঠার পুরাণ। কোন কিছুতেই মোর জুড়ায় না প্রাণ।। কি করিব কোথা যাব ভাবিয়া না পাই। বলে গুরু কি করিব তোমাকে জানাই।। নারদ বলিল তুমি শুন বাছাধন। শ্রী শ্রী হরি লীলামৃত করহে লিখন।। লীলামৃত লেখ তুমি ভক্তি রস দিয়া। ভক্তগণে পাবে শান্তি সে গ্রন্থ শুনিয়া।। তুমিও পাইবে শান্তি সে গ্রন্থ লিখিয়া। হরি লীলামৃত লেখ শ্রী হরি ভাবিয়া।। এত কহিলেন যদি ব্রাহ্মণ নন্দন। ব্যাস মুনি করিলেন চরণ বন্দন।। তুষ্ঠ হয়ে সে নারদ স্বর্গ পথে গেল। আশ্রমে আসিয়া ব্যাস ভাবিতে লাগিল।। গুরুর আদেশ বাণী শুনিয়া কর্ণেতে। হরি লীলামৃত কথা লিখিব কি মতে।। তারপর ভাববত সংহিতা লিখিল। শ্রী শ্রী লীলামৃত লেখা না হইল।। তারপর কত দিন গত হয়ে যায়। কি লিখিব কি লিখিব ভাবিয়া না পায়।। তারপর ব্যাসদেব লীলা সাঙ্গ করি। সূক্ষ্ম দেহ ধরি গেল বৈকুন্ঠ নগরী।। কালেতে দ্বাপর যুগ হয়ে গেল শেষ। তারপর হইলে যে কলির আবেশ।। বৈকুন্ঠে থাকিয়া ব্যাস ভাবে মনে মন। আত্মার অশান্তি কভু ছাড়ে না কখন।। এক দিন বৈকুন্ঠেতে নারদ উদয়। নারদে হেরিয়া ব্যাস ধরিলেন পায়।। কেন্দে বলে ওহে গুরু করি নিবেদন। অধমেরে ক্ষমা করে দেহ শ্রী চরণ।। তব আজ্ঞা না পালিয়া শান্তি নাহি পাই। এবে আমি কি করিব চরণে জানাই।। ব্যাসেরে কাতর দেখি বিধি পুত্র কয়। হরি অবতারে গিয়ে জন্মিবে ধরায়।। হরি লীলামৃত কথা লিখিও যতনে। তাহা হলে পাবে শান্তি যত ভক্তগণে।। সেই হেতু ব্যাস মুনি জনম লভিল। তারক নামেতে তার এ জনম হল।। সুবোধ চরিত ভাগবতে লেখা আছে। এগারশ চার পৃষ্ঠা মোর দেখা আছে।। অধম বিনোদ বলে বেলা বেশি নাই। হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।। শ্রী শ্রী তারক চাঁদের হরি দর্শণ হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ভাবিয়া হৃদয়। তারক চাঁদের কথা লিখিব ভাষায়।। শিশু রূপে ব্যাসদেব মাতৃ কোলে বসে। চরিদিকে নিরিখিয়া খল খল হাসে।। তাই দেখে অন্নদার ভরে ওঠে বুক। তারকের ভাব দেখে কত পায় সুখ।। কাশীনাথ তারকের কোলেতে করিয়া। আনন্দেতে আত্মহারা বেড়ায় নাচিয়া।। এই ভাবে কতদিন গত হয়ে গেল। পঞ্চ বর্ষ গত হলে হাতে খড়ি দিল।। পাঠশালে সে তারক বিদ্যা শিক্ষা করে। একবার শোনে যাহা বলে দিতে পারে।। শিক্ষক্ষেরা তারকেরে অতি ভালবাসে। অতি যত্নে শিক্ষা দেয় মনের উল্লাসে।। এত বড় শ্রুতিধর কভু দেখি নাই। মনেতে আনন্দ পায় শিক্ষক সবাই।। এই ভাবে বিদ্যাশিক্ষা করিতে লাগিল। প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ হযে গেল।। তারপর কাশীনাথ তারকে লইয়া। কবিগান শিক্ষা দেয় আসরেতে নিয়া।। পাঁচালী বলিতে যবে কবির খোলায়। বসিয়া শুনিত তাহা অনন্দ হৃদয়।। তারপর বাহিরেতে যখন আসিত। সে তারক সেই ভাবে পঁচালী বলিত।। তাই শুনি সকলেতে মানিত বিশ্বয়। এই ছেলে বড় কবি হইবে নিশ্চয়।। তাই শুনি কাশীনাথ আনন্দ হৃদয়। তারকেরে কোলে করি মুখে চুমু দেয়।। বাড়ী এসে তারকেরে শাস্ত্র পড়াইত। অল্পদিনে সেতারক মুখস্থ করিত।। গীতা গ্রন্থ অল্প দিনে কন্ঠস্থ হইল। বেদ পুরাণাদি সব শিক্ষা করে নিল।। পিতার কাছেতে কবিগান শিক্ষা করে। তারপর কি হইল বলিব সবারে।। পঞ্চদশ বর্ষ যবে হইল তাহার। শুভক্ষণে কাশীনাথ তেজিল সংসার।। পিতৃ হারা সে তারক কান্দিতে লাগিল। কোনমতে পিতৃ কার্য্য সমাধা করিল।। কি করিবে কোথা যাবে ভাবিয়া না পায়। মায়ের চরণ ধরি কেন্দে কেন্দে কয়।। বল মাগো কি করিব চরণে জানাই। কি ভাবে বাঁচিব মাগো বলে দাও তাই।। অন্নদা বলিল বাবা শুন দিয়া মন। পিতার আদর্শ তুমি করহে পালন।। সূর্য্য নারায়ণ আছে ডুমুরিয়া গায়। কাঙ্গালি নামেতে আছে সেই মদুয়ায়।। কবির দোয়ার তারা ভাল দুই জন। দল করি কবি গাও শুন বাছাধন।। মাতৃ আজ্ঞা শুনি কানে তারক সুজন। সূর্য্য নারায়ণে গেল আনিতে তখন।। সূর্য্য আর কাঙ্গালীকে সঙ্গেতে করিয়া। দেশে দেশে কবিগান বেড়ায় গাহিয়া।। তারকের কন্ঠস্বর মোটে ভাল নয়। ধুয়া গান গেলে পরে লোকে মন্দ কয়।। এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল। মাঝে মধ্যে কবিগান গাহিতে লাগিল।। একদিন চলিলেন চালনা গ্রামেতে। সূর্য্য নারায়ণ আর কাঙ্গালী সঙ্গেতে।। কবিগান গাহিবারে হইল উদয়। সেই দিন সেই গ্রামে আসে মৃত্যুঞ্জয়।। কাঙ্গালীর গুরু সেই সাধু মৃত্যুঞ্জয়। কালীনগরেতে বাস করে মহাশয়।। কাঙ্গালী চরণে গিয়া প্রণাম করিল। সূর্য্য নারায়ণ গিয়ে পদে প্রণামিল।। উভয়ের গুরু সেই সাধু মৃত্যুঞ্জয়। তাই দেখে সে তারক ভাবিল হৃদয়।। কেমন গোঁসাই এই ভাবিতে লাগিল। কি যেন কি আকর্ষণে প্রেম সঞ্চারিল।। তারপর গেল সবে কবির খোলায়। কবি গাহিতেছে সবে আনন্দ হৃদয়।। হেন কালে মৃত্যুঞ্জয় হইল উদয়। সযতনে সবে মিলে আসনে বসায়।। মৃত্যুঞ্জয় গান শোনে আসরে বসিয়ে। তারকের মন গেল দিশে হারা হয়ে।। কি যেন কি আকর্ষণে ভুল হয়ে যায়। তাই মৃত্যুঞ্জয় দেখে হইল বিদায়।। আশ্রমেতে গেল তিনি কাঙ্গালীকে কয়ে। সকালে যাইও সবে তারকেরে লয়ে।। সেই গ্রামে গান শেষে রাত্রি কাটাইল। প্রভাতে উঠিয়া সবে আশ্রমেতে গেল।। আশ্রমে বসিয়া আছে সাধু মৃত্যুঞ্জয়। হেন কালে কয় জন হইল উদয়।। তারক কাঙ্গালী আর সূর্য্য নারায়ণ। প্রণাম করিল সবে আনন্দিত মন।। হরি বলে আশীর্বাদ করিল গোঁসাই। সকলেতে সুখে রবে কোন চিন্তা নাই।। শুন শুন ও তারক আমার বচন। গতকাল কবিগান করিলে যখন।। শ্রী কৃষ্ণের রূপ তুমি করিলে বর্ণণ। নিজে কি দেখেছ তুমি শুন বাছাধন।। তারক বলেছে আমি নিজে দেখি নাই। শাস্ত্রে যাহা লেখা আছে বলিলাম তাই।। তাই শুনি মৃত্যুঞ্জয় বলিল তখন। নিজে তুমি দেখ নাই করিলে বর্ণণ।। লেখা কথা দিয়ে তুমি বর্ণণা করিলে। আরো কত ভাল হত স্বচক্ষে দেখিলে।। তারক বলেছে কেউ দেখাইতে পারে। চরণের দাস হব এই ধরা পরে।। তারকের কথা শুনে বলে মৃত্যুঞ্জয়। মোর সঙ্গে ভগবান হাসি কথা কয়।। ক্ষীরোদ সাই শ্রীহরি জন্মিল ধরায়। লীলা করে ধরা ধামে ওড়াকান্দি গাঁয়।। পতিত পাবন বলে অবতীর্ণ হল। হরিনামে পাপতাপ সকল নাশিল।। তারক বলেছে আমি আশ্চর্য্য হয়েছি। চাব্বক পুরানে আমি দেখিতে পেয়েছি।। ক্ষীরোদ সাই হরির অঙ্গে চিহ্ন আছে। বত্রিশটি চিহ্ন তার অঙ্গেতে রয়েছে।। তাই যদি নিজ চোখে দেখিবারে পাই। চির দাস হয়ে রব চরণে জানাই।। তাই শুনে মৃত্যুঞ্জয় বলিল বচন। নিজ চোখে দেখে নিও ওহে বাছাধন।। হিসাব করিয়া তুমি দেখিবে কখন। দেখিলে স্বার্থক হবে তোমার জীবন।। তাই শুনি শ্রী তারক প্রণমিল পায়। ছল ছল আখি দু’টি কেন্দে কেন্দে কয়।। আজ হতে তুমি মোর গুরু রূপ হও। মোরে নিয়ে ওহে গুরু হরিকে দেখাও।। গুরু পদে ধরি কান্দে তারক সুজন। ভক্তি গদ গদ চিত্তে ঝরে দু’নয়ন।। তারকের কান্না দেখে কহে মুত্যুঞ্জয়। শুন শুন ওরে বাছা বলি যে তোমায়।। ঠাকুর দেখিবে বলে মন যদি চায়। নিশ্চই ঠাকুর আমি দেখাব তোমায়।। এই রূপে ভক্তি পদে থাকে যদি মন। করুণা করিয়া হরি দিবে দরশন।। এই কথা বলে তিনি তারকে ধরিল। হস্ত ধরে উঠাইয়া শান্তনা করিল।। প্রশস্থ গার্হস্থ ধর্ম শিখাবার তরে। হরিচাঁদ অবর্তীর্ণ এ ভব সংসারে।। হাতে কাম মুখে সদা হরি নাম সার। অনায়াসে হয়ে যাবি ভব সিন্ধু পার।। এই ভাবে তারকেরে কত বুঝাইল। বলে কয়ে তারকেরে বিদায় করিল।। গৃহে গিয়ে তারকের মন সুস্থ নাই। হরিচাঁদ দেখিবারে কেন্দে ছাড়ে হাই।। পুনরায় আসিলেন মৃত্যু্ঞ্জয় ঠাই। কেন্দে বলে ওহে গুরু তোমাকে জানাই।। হরিচাঁদ দেখিবারে মন উচাটন। এখনি আমাকে নিয়ে কর হে গমন।। তাই শুনি মৃত্যুঞ্জয় কহিল তখন। ভোজন করিয়া মোরা করিব গমন।। মৃত্যুঞ্জয় ডেকে বলে কাশীশ্বরী ঠাই। শীঘ্র করে খেতে দাও শ্রীধামেতে যাই।। তাই শুনে কাশীশ্বরী রন্ধন করিল। রন্ধন করিয়া দেবী কহিতে লাগিল।। সেবায় বসিবে সবে করেছি রন্ধন। তাই শুনে দুই জন করিল ভোজন।। ভোজনান্তে দুই জনে শ্রীহরি স্মরিয়া। যাত্রা করে ওড়াকান্দি আনন্দে মাতিয়া।। অগ্রভাগে মৃত্যুঞ্জয় করিল গমন। পিছে পিছে চলিতেছে তারক সুজন।। জলে ভরা আখি দু’টি চলে পিছে পিছে। উদয় হইল গিয়ে ঠাকুরের কাছে।। তারকে হেরিয়া হরি কহিল তখন। হাসিমুখে কহিতেছে মধুর বচন।। বল দেখি মৃত্যুঞ্জয় কোথা হতে আলি। এই তোতা পাখি তুই কোথায় পাইলি।। আমাকে দিয়ে যাবি এই তোতা পাখি। তাইলেই অন্তরেতে হই আমি সুখি।। এই কথা যখনেতে হরিচাঁদ কয়। তারক হেরিয়া রূপ ভাবলি হৃদয়।। অনিমেষে চেয়ে চেয়ে ভাবিতে ভাবিতে। ঠাকুরের অঙ্গচিহ্ন লাগিল গুনিতে।। এক হতে অষ্টবিংশ গুনিল যখন। অন্তর্যামী হরিচাঁদ জানিল তখন।। হস্তপদ বিস্তারিয়া আলস্য ছাড়িল। আর চারি চিহ্ন তাহে দেখিতে পাইল।। তাই দেখে সে তারক চরণে পড়িল। চরণ ধরিয়া শেষে কান্দিতে লাগিল।। কেন্দে বলে ওগো প্রভু করি নিবেদন। দয়া করে অধমেরে কর হে গ্রহণ।। ক্ষীরোদের সাই তুমি পূর্ণানন্দ হরি। তোমার গুণের সীমা বর্ণিতে কি পারি।। তুমি হরি গুণনিধি জগতের সার। আজ হতে মন প্রাণ সকল তোমার।। ঠাকুর বলেছে বাছা মন ঠিক চাই। তোর মত ভক্ত যেন যুগে যুগে পাই।। প্রশস্থ গার্হস্থ ধর্ম পালন করিবে। হাতে কাম মুখে সদা হরি নাম লবে।। পর স্ত্রীকে মাতৃবত দেখিবে সদায়। মুখে সত্য কথা কবে সকল সময়।। আমার এ যুগ ধর্ম করিবে প্রচার। সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় হরি নাম সার।। তাই শুনে সে তারক কান্দিয়া কহিল। মোর এক নিবেদন চরণে রহিল।। দেশে দেশে ওগো প্রভু কবিগান গাই। কন্ঠস্বর ভাল নয় চরণে জানাই।। তারকের কথা শুনে হরিচাঁদ কয়। শুন শুন ও তারক বলি যে তোমায়।। হাটে গিয়ে যার সনে তব দেখা হবে। মোর গান শোনে নাক তাহাকে কহিবে।। সাত হাট সেধে সেধে হও অপমান। তারপর ওগো বাছা গাও কবিগান।। সে সব বৃত্তান্ত লীলামৃত লেখা আছে। নিজ হাতে শ্রী তারক তাহা লিখিয়াছে।। সেই হতে সে তারক হইলেন ভক্ত। পাশরিতে নারে গুণ সদা কর ব্যক্ত।। দেশে গিয়ে সে তারক হাটে হাটে গিয়ে। মোর গান শোনে নাক বেড়ায় কহিয়া।। সাত হাটে সেধে সেধে হল অপমান। তারপর সে তারক গায় কবিগান।। অধম বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে। তারকের ছবি খান হৃদয়েতে বন্দে।। তাই বলি ভাই সব বেলা বেশি নাই। হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।। তারকের মাথায় হরিচাঁদ হরিচাঁদ ছবি খানি হৃদয় ধরিয়া। সে তারক কবিগান বেড়ায় গাহিয়া।। একদিন ওড়াকান্দি হইল উদয়। হরিচাঁদ পদ ধরি কেন্দে কেন্দে কয়।। শুন শুন শুন প্রভু করি নিবেদন। অধমের এ মিনতি কর হে গ্রহণ।। ঢাকা ধামে যাব আমি করিবারে গান। কৃপা করে আশির্বাদ কর মোরে দান।। তাই শুনি হরিচাঁদ কহিল তখন। আমা প্রতি সদা তব থাকে যেন মন।। মন খাটি চাই বাছা মন খাটি চাই। আমার কৃপায় তোর কোন চিন্তা নাই।। হেন কালে শান্তি মাতা আসিল তথায়। মায়ের চরণ ধরি কেন্দে কেন্দে কয়।। শুন শুন শুন মাগো চরণে জানাই। পদে যেন থাকে ভক্তি এই ভিক্ষা চাই।। তারকের কান্নাদেখে শান্তি মাতা কয়। তোমার মনের বাঞ্ছা পূর্ণ যেন হয়।। ঢাকায় যাইবে তুমি গান গাহিবার। মম অভিলাষ বাছা কহিব এবার।। এক জোড়া ভাল শাঁখা এনে মোরে দাও। আমার মনের বাঞ্ছা তুমি হে পুরাও।। তাই শুনি সে তারক পড়িলেন পায়। মায়ের চরণ ধুলি মাখিলেন গায়।। ঠাকুরে চরণ ধুলী অঙ্গেতে মাখিয়া। আসিলেন সে তারক ঘরতে ফিরিয়া।। তারপর দল বল সঙ্গেতে করিয়া। বুধবারে করে যাত্রা শ্রীহরি স্মরিয়া।। নৌকা যোগে করিলেন ঢাকায় গমন। সুন্দর তরণী খানি অতি সুশোভন।। নদী পথে বেয়ে বেয়ে চলিতে লাগিল। চারদিন পরে তরী ঢাকায় পৌছাইল।। জমিদার বাড়ী গান শুনিতে পাইল। সেই ঘাটে সে তারক তরণী বাঁধিল।। একদল আসিয়াছে পূর্বে সে বাড়ীতে। নাম করা কবিয়াল বিখ্যাত জগতে।। মন্ত্র তন্ত্র জানে ভাল দুই মহাশয়। বিপক্ষের কন্ঠস্বর বন্ধ করে দেয়।। অন্য দল তার সনে আটিতে পারে না। সেই জন্য অন্য কেউ সেখানে আসে না। তারকেরে পেয়ে তারা বায়না করিল। দল বল লয়ে সেথা উদয় হইল।। তার পর উঠিলেন কবির খেলায়। বিপক্ষের সরকার দেখিবারে পায়।। সকলের কন্ঠস্বর বন্ধ করে দিল। গান গাহিবারে তারা কেহ না পারিল।। তাই দেখে সে তারক কেন্দে ছাড়ে হাই। কোথা বাবা হরিচাঁদ চরণে জানাই।। আমি অতি মুঢ় মতি না জানি সাধন। বিপদে পড়িয়া আজি লইনু স্মরণ।। তুমি যারে রক্ষা কর ওগো দয়াময়। জীবনে মরণে আর নাহি কোন ভয়।। হরিচাঁদ ছবি খানি হৃদয় ধরিয়া। নয়ন জলে বক্ষ জেতেছে ভাসিয়া।। তারকের কান্না শুনি হরি দয়াময়। পুত্তলিকা মুর্তি ধরি বসিল মাথায়।। কোথাকার স্বর বন্ধ কোথায় লু’কাল। সবাকার অন্তরেতে আনন্দ বাড়িল।। সকলের কন্ঠস্বর হইল মধুর। শ্রোতাগণ বলে সব মধুর মধুর।। তারপর সে তারক ধরে ধুয়া গান। ধুয়া গানে হরে নিল সবাকার প্রাণ।। শ্রোতা যারা ভাসে তারা নয়নের জলে। আধ আধ ভাষা দিয়া হরি হরি বলে।। কেহ কেহ কেন্দে কেন্দে গড়াগড়ি যায়। কেহ এসে পড়িলেন তারকের পায়।। এক শিশু বসে ছিল পিতার কোলেতে। হরিচাঁদ ছবি খানি দেখিল চোখেতে। জলে ভরা আখি দু’টি লাগিল কান্দিতে।। পুতুলেতে খেলা করে তারকের মাথে। তাই দেখে সে বালক কান্দিতে লাগিল।। তার পিতা তারে লয়ে গৃহে চলি গেল। আসরেতে শ্রোতা যারা জ্ঞান হারা প্রায়।। প্রেমের তরঙ্গে তারা ভাসিয়া বেড়ায়। জমিদার গান শোনে বসে দোতালায়। বিপক্ষের কবিয়াল ছিল যে সেথায়।। দুই জনে গান শুনে ভাসে আখি জলে। জ্ঞান হারা প্রায় তারা নামে ভূমী তলে।। কবির খোলায় গিয়ে পড়িল ধরায়। তারকের পদে পড়ে গড়াগড়ি যায়।। হেন দৃশ্য হলো সেথা কহন না যায়। আকাশে বাতাসে যেন হরিগুণ গায়।। বিপক্ষের সরকার ভাসি আখি জলে। তারকের পদ ধরি কেন্দে কেন্দে বলে।। তুমি হও মহাজন এই ধরা পরে। অপরাধ করিয়াছি ক্ষমা কর মোরে।। তন্ত্র মন্ত্র শিখে আমি কবিগান গাই। তব কাছে তন্ত্র মন্ত্র পুড়ে হল ছাই।। তোমার চরণে আজ নিয়েছে স্মরণ। কি করিব কোথা যাব বলহে এখন।। তাই শুনি তারকের দয়া উপজিল। সান্তনা করিয়া তারে কহিতে লাগিল।। শুন শুন শুন বাছা বলি তব ঠাই। তন্ত্র মন্ত্র দিয়ে আর কার্য কিছু নাই।। হরি নাম মহা মন্ত্র জগতের সার। অনায়াসে হয়ে যাবে ভব সিন্ধু পার।। যাও বাছা দেশে চলে কর কবিগান। মন খাটি হলে পরে বাড়িবে সম্মান।। তাই শুনে সে বেচারা বিদায় হইল। তারকের আজ্ঞা পেয়ে দেশে চলি গেল।। জমিদার তারকেরে সভক্তি অন্তরে। ভোজনাদি করাইল অতি সমাদরে।। দল বল সহ তিনি রহিল তথায়। পরদিন সবে মিলে হইল বিদায়।। বাড়ী থেকে যখনেতে আসি রাস্তায়। একটি বালক এসে তারকেরে কয়।। শুন শুন শুন তুমি আমার বচন। গতকাল গান তুমি করিলে যখন।। নিজ চোখে দেখি তব মাথার উপর। একটি পুতুল তুমি রাখিয়াছ সেরে। আমাকে দেখাও তুমি দেখি প্রাণ ভরে।। এই কথা বলে সে যে কান্দিতে লাগিল। অমিন তারক তারে বুকেতে ধরিল।। সে ছেলেকে ধরে বুকে ছাড়ে আখি জল। আধ আধ ভাষা দিযে বলে হরিবল।। মস্তকেতে হস্ত দিয়া লাগিল বলিতে। তোমা সম ভাগ্যবান নাহি এ জগতে।। সে পুতুল থাকে কোথা বলি তব ঠাই। ওড়াকান্দি আছে সেই ক্ষীরোদের সাই।। তাই শুনে সাথে যারা কান্দিতে লাগিল। কেন্দে কেন্দে তারকের চরণে পড়িল।। সূর্য্য নারায়ণ আর কাঙ্গালী বেপারী। নয়ন জলে তে ভেসে বলে হরি হরি।। এই ভাবে সবে মিলে কান্দিতে লাগিল। বহুক্ষণ পরে সবে সুস্থির হইল।। তারপর সে বালকে সান্তনা করিয়া। তথা হতে চলিলেন বিদায় হইয়া।। তারপর বহু স্থানে কবিগান করি। দেশেতে চলিল সবে বলে হরি হরি।। ঢাকা হতে এক জোড়া শাঁখা কিনে নিয়ে। উদয় হইল শেষে ওড়াকান্দি গিয়ে।। শান্তি মার চরণেতে সেই শাঁখা দিয়ে। স্তুতি করে সে তারক কান্দিয়ে কান্দিয়ে।। খুশি হয়ে শান্তি দেবী আশীর্বাদ করে। শুন শুন শুন বাছা বলি যে তোমারে।। তোমার মনের বাঞ্ছা পূর্ণ যেন হয়। ভক্তি পথে মন যেন সদা তব রয়।। তারক বলেছে মাগো অন্য আশা নাই। পদে যেন থাকে ভক্তি এই ভিক্ষা চাই।। তারপর সে তারক কান্দিয়া কান্দিয়া। শান্তি হরিচাঁদ পদ বন্দনা করিয়া।। জয়পুর চলিলেন হরষিত মন। ভাবে গদ গদ চিত্ত ঝরে দু’নয়ন।। এ দিকেতে লক্ষ্মীপাশা কালীমাতা যিনি। মনে মনে বিষাদিত হইলেন তিনি।। ভাবিলেন শান্তি মাকে শাঁখা পরাইল। আমাকেও সে তারক শাঁখা নাহি দিল।। আমার বরেতে সেই আসিল ধরায়। আমাকে বঞ্চিত করে কেমন হৃদয়।। আমি তারে ভালবাসি পুত্রের সমান। কন্যা রূপে শাঁখাপরি জুড়াই পরাণ।। মনে মনে কালীমাতা বাসনা করিল। এই ভাবে বহুদিন গত হয়ে গেল।। অধম বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে। হরিচাঁদ ছবি খানি হৃদয়েতে বন্দে।। তাই বলি ভাই সব বেলা বেশি নাই। হরিচাঁদ প্রিতে সবে হরি বল ভাই।। তারকের কন্যা রূপে কালি উদ্ধারণ দত্ত নামে, বাস করে ঢাকা গ্রামে শহরেতে বাণিজ্য করয়। শাঁখার ব্যবসা করে, ফেরি করে সদা ফেরে মাঝে মাঝে দোকানেতে রয়।। নৌকা যোগে নদী ঘাটে, শাঁখার দোকান লয়ে ঘাটে ঘাটে নৌকা ভিড়াইয়া।। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে, কত শাঁখা বিক্রি করে পুনরায় আসিতে ফিরিয়া।। সহজ সরল মনে, মাতৃ ভাব নারীগণে নির্বিকার সত্যের স্বভাব। একদরে বেচা কেনা, সকলের জানা শোনা সংসারেতে না ছিল অভাব।। একদিন নৌকা বেয়ে, নবগঙ্গা নদী দিয়ে আসিলেন লক্ষ্মীপাশা গাঁয়। জাগ্রত সে কালীমাতা, লোক মুখে শুনি কথা মন্দিরেতে হইল উদয়।। ডালা দিয়ে মার পদে, কহিলেন কেন্দে কেন্দে শুন মাগো বলি যে তোমায়। ভাল কেনা বেচা হলে, পুন তব পদ তলে আসিয়া পূঁজিব তব পায়।। কালীমার পদ তলে, মানত করিয়া চলে গ্রামে গ্রামে ঘুরিতে লাগিল। কাছে যত শাঁখা ছিল, সব শাঁখা বিক্রি হল পুনরায় নৌকায় আসিল।। নৌকা হতে শাঁখা নিয়ে, কুলে এসে দেখে চেয়ে এক মেয়ে দাঁড়াইয়া রয়। ঘোর কৃষ্ণ বর্ণা মেয়ে, শাঁখারীর কাছে গিয়ে সজল নয়নে মেয়ে কয়।। শুন বলি ও শাঁখারী, বিলম্ব সহিতে নারী এক জোড়া শাঁখা আজি দাও। ব্যালয়ারী শাঁখা নিতে, বাসনা রয়েছে চিতে শীঘ্র মোর বাসনা পুরাও।। শাঁখারী দেখিয়া তাই হেন রূপ দেখি নাই সজল নয়নে দেখে চেয়ে। মুখে মৃদু মন্দ হাসি, এলাই কেশ রাশি মাতৃ মুর্তি আছে দাঁড়াইয়ে।। শাঁখারী সে দিসে হারা মাতৃ ভাব হৃদি পোরা স্নেহভরে শাঁখা পড়াইল। শাঁখা দিয়ে দুই হাতে, ঝরে আখি নয়নেতে ক্ষীণ স্বরে কহিতে লাগিল।। শুন বলি ওগো মাতা, তোমার বসতি কোথা সত্য করি দেহ পরিচয়। তব হাতে শাঁখা দিতে, হেন জ্ঞান হয় চিতে কোন দেবী হইবে নিশ্চয়।। তাই শুনি কালীমাতা, ছল করি কয় কথা মোর পিতা জয়পুর বাস। শ্রী তারক চন্দ্র নাম, কবি গানে অনুপম কবি মধ্যে বিখ্যাত থরায়।। শুনিয়া শাঁখারী তাই, শাঁখার যে মূল্য চাই এ শাঁখার দুই টাকা দাম। শিঘ্র করি দাও টাকা, বেচিতে যাইব শাঁখা বিলম্বেতে নাহি কোন কাম।। শুনি শাঁখারীর বাণী, বলে মাতা তৃনয়নী টাকা দিবে আমার পিতায়। হয়ে নদী তুমি পার, যাহ পিতার গোচরে মোর পিতা অতি সদায়শ।। যদি টাকা নাহি থাকে, কহিও মোর পিতাকে গৃহ মধ্যে ছিকার উপর। তিন হাড়ী তাতে আছে, যেই হাড়ী আছে নিচে টাকা আছে তাহার ভিতর।। কহিও বাবার কাছে, তব কন্যা শাঁখা নিছে তাব কন্যা মায়া নাম তার। আমি তার কন্যা একা, চাহিলে সে দিবে টাকা মিছে তুমি ভাবিও না আর। শাঁখারী শুনিয়া তাই, ছাড়িয়া দুঃখের হাই মনে মনে ভাবিতে লাগিল। আগে আমি না জানিয়া, ভুল করি শাঁখা দিয়া শাঁখা বিক্রি বৃথা হয়ে গেল।। আর আয় কি করিব, টাকা বুঝি নাহি পাব বাকী পলে ফাকি হয়ে যায়। অজানা এ দেশে এসে, বাকীতে পড়িলে শেষে টাকা বুঝি আদায় না হয়।। তাই ভেবে মেয়েটিরে, কহিলেন ধরী ধীরে ওগো মাগো বলি তব ঠাই। মম সঙ্গে চল তুমি, তব সঙ্গে যাব আমি হাতে হাতে টাকা যাতে পাই।। তাই শুনি কালীমাতা, ছল করি কয় কথা শুন তুমি আমার বচন। এই খানে থাক তুমি, মন্দিরেতে যাব আমি পরে এসে করিব গমন। মায়ার মায়ায় ভুলে, এ জগত সদা চলে শাঁখারী, সে ভুলিল মায়ায়। কালীমাতা চলি গেল, মন্দিরেতে প্রবেশিল ফিরিয়ে না এল পুনরায়।। বহুক্ষণ দেরি হল, মায়া ফিরে না আসিল শাঁখারী হইয়া নিরুপায়। ব্যস্ত হয়ে তথা গিয়ে, মন্দিরেতে দেখে চেয়ে কোন মেয়ে দেখিতে না পায়।। আসিয়া নদীর তীরে, বেয়ে তরী ধীরে ধীরে নৌকা হতে কুলেতে নামিল। মনে তার এই ভাব, তারকের বাড়ী যাব নিরাশায় হাটিতে লাগিল।। গিয়ে তারকের বাড়ী তারকের চক্ষে হেরি কহিতেছে বিনয় করিয়া। কহ ভাই কহ মোরে, চেন নাকি তারকেরে সেই বাড়ী দেহ চিনাইয়া।। হাসিয়া তারক কয়, এই বাড়ী তার হয় তারক আমার নাম হয়। আসিয়াছ কি কারণ, কহ তব প্রয়োজন শীঘ্র করি কহত আমায়।। শুনিয়া শাঁখারী কয়, শুন শুন মহাশয় তব কন্যা শাঁখা পরিয়াছে। নদী পারে হল দেখা, আমি তারে দেই শাঁখা মূল্য দিতে তোমাকে বলেছে।। শুনিয়া তারক কয়, শুন বলি মহাশয় এখনও বিবাহ করি নাই। কন্যা এল কোথা, হতে, আসিয়াছ ফাঁকি দিতে মনে তুমি ভেবে দেখ তাই।। শুনিয়া শাঁখারী তাই, ছাড়িয়া দুঃখের হাই মন দুঃখে কহিতে লাগিল। ফাঁকি দিতে আসি নাই, ফাঁকিতে পড়েছি ভাই মোর কথা মিথ্যা হয়ে গেল।। মায়া নাত (নাম) তার হয়, কন্যা দিল পরিচয় তারক আমার পিতা হয়। টাকা যদি নাহি থাকে, বলিও মোর পিতাকে কোথা টাকা বলেছে আমায়।। গৃহ মধ্যে আছে ছিকা, হাড়ীতে হাড়ীতে ঢাকা তিনটি হাড়ী ছিকার মধ্যেতে। তার মেধ্য নীচে যেটা, সে হাড়ীতে আছে টাকা সেই টাকা কহিয়াছে দিতে।। শুনিয়া তারক তাই, আখিতে অন্ত নাই অনিমেষে গৃহ মধ্যে গেল। হাড়ী মধ্যে টাকা হেরি, আখিতে ঝড়েছে বারি মনে মনে ভাবিতে লাগিল।। সেই টাকা হাতে করি, মুখে বলে হরি হরি তখনি সে বাহিরেতে এল। শাঁখারীর হাতে ধরি, কহিয়া বিনয় করি সেই টাকা শাঁখারীকে দিল।। টাকা দিয়া তার হাতে, আখিজল নয়নেতে কেন্দে কেন্দে কহিল তখন। ভুল হয়ে গেছে ভাই, তব কাছে ক্ষমা চাই মেয়ে মোর আছে একজন। কাল বরণ চেহারা, অভিমানে বুক ভরা মম সঙ্গে কথা নাহি কয়। তোমার পাইয়া দেখা, হাতে পরিয়াছে শাঁখা তার টাকা দিলাম তোমায়।। তারকের চোখে জল, করিতেছে টলমল শাঁখারী সে কহিল তখন। কহ কহ কহ তাই, কান্দিতেছ কেন ভাই কেন তুমি হয়েছ এমন।। তারক কান্দিয়া বলে, ভাসিয়া নয়ন জলে শাঁখারীর হস্ত ধরি কয়। মম কন্যা গেল কোথা, চল চল যাব সেথা মেয়ে মোর লুকাল কোথায়।। তারকের ভাব হেরি, দিশে হারা সে শাঁখারী সজল নয়নে কেন্দে কয়। মন্দির ভিতরে গেল, আর নাহি ফিরে এল চল গিয়ে দেখি দু’জনায়।। দুজনার শিহরণ, জাগিতেছে সর্বক্ষণ ভাবাবেশে মন্দিরেতে গেল। প্রস্তর মুরতী খানি, কালীমাতা তৃনয়নী সেই হাতে শাঁখা শোভা ভাল।। শাঁখারী দেখীয়া তাই, কেন্দে কেন্দে ছাড়ি হাই করজোড়ে কহিতে লাগিল। মানুষের রূপ ধরি, ছল করি শাঁখা পরি মন্দিরেতে আসিয়া লুকাল।। এত বলি সে শাঁখারী, কেন্দে যায় গড়াগড়ি তারকের পদ ধরি কয়। তুমি সাধু মহাজন, করি এক নিবেদন দয়া করে রেখ তব পায়।। তোমাকেই পিতা বলে, মম হাতে শাঁখা নিলে তুমি হও জগতে মহান। কি দিব তুলনা তোমা, গুণের নাহিকো সীমা অধমের কর প্রেমদান।। তরক কান্দিয়া কয়, হেরি বলি রসনায় শাঁখারী কে বুকেতে ধরিল। ভাসিয়া নয়ন জলে, শাঁখারিকে কেন্দে বলে তোমা পেয়ে হৃদয় শুধিল।। ধরাধরী দুই জনে, পড়ে তারা ধরাসনে মায়ের চরণ ধরি কান্দে। কান্দিয়া কান্দিয়া কয়, পদে যেন মতিরয় দুইজনে ভাসে প্রেমানন্দে।। এই ভাবে কান্দি কান্দি মায়ের চরণ বন্দি যার যার গন্তবেতে গেল। সে হতে তারক চন্দ্র, মনে হয়ে প্রেমানন্দ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিল।। দুই জোড়া শাঁখা কিনে, বছরে বছরে এনে একজোড়া শান্তিমাকে দেয়। আর জোড়া শাঁখা নিয়ে, কালীমার হাতে দিয়ে মনে মনে বাসনা পুরায়।। হরিভক্ত যারা যারা, প্রেমানন্দ তনু পোরা ভালবাসে সর্ব দেবতায়। কান্দিয়া বিনোদ বলে, এ জনম গেল চলে অধমের কি হবে উপায়।। শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া সমাজ ভক্ত বাঞ্ছা কল্পতরু চারিদিকে ভক্তগণ মাঝে হরিচাঁদ। তারা গণ্য মধ্যে যেন আকাশের চাঁদ।। এইভাবে বসে আছে হরি দয়াময়। হেন কালে শ্রী তারক আসিল তথায়।। তারকেরে ডাক দিয়া কহিল তখন। শুন শুন শুন বাছা আমার বচন।। প্রশস্থ গার্হস্থ ধর্ম শিখাবার তরে। আমি আসিয়াছি তাই জানাতে সবারে।। লয়ে নারী ব্রহ্মচারী সত্য কথা কবে। আমার এ যুগ ধর্ম পালন করিবে।। বিবাহ কর হে বাছা গৃহস্থ সাজিয়া। গৃহ কর্ম শ্রেষ্ঠ হয় দেখরে ভাবিয়া।। তারক বলিছে প্রভু বিয়া না করিব। বিবাহ করিলে আমি পাশ বদ্ধ হব।। নারী লোভে অর্থ লোভে কামাসক্ত হয়ে। নষ্ট হবে এ জীবন তোমাকে ভুলিয়ে।। তারকের কথা শুনে বলে দয়াময়। বিবাহ করিলে বাছা আমার কথায়।। নাম প্রেম বৃদ্ধি হবে আমি বলি তাই। আমাকে পাইবি তোর কোন চিন্তা নাই।। তারক বলেছে মোরা টাকা কড়ি নাই। কেনা বেচা করে হাটে সংসার চালাই।। ঠাকুর বলেছে বাচা মন ঠিক চাই। আমি দিব সব টাকা কোন চিন্তা নাই।। সূর্য্য নারায়ণ আর সাধু মৃত্যুঞ্জয়। দু’জনারে ডাক দিয়া হরিচাঁদ কয়।। তোমরা দুজনে যাও ভাগুড়া গ্রামেতে। (লাইন জ্ঞাপ হয়ে গেছে) তাই শুনে কয়জনে করিল গমন।। বিয়ে দিল তারকের ঠাকুরের মতে। চিন্তামণি নামে কন্যা হল তার সাথে।। সে সব বৃত্তান্ত লীলামৃত লেখা আছে। নিজ হাতে শ্রী তারক তাহা লিখিয়াছে।। এই ভাবে কতদিন গত হয়ে গেল। দাম্পত্য জীবনে তারা অতি সুখি হল।। ভক্ত মন বুঝিবারে হরি দয়াময়। দুঃখ কষ্ট দিয়ে তারে মন বুঝে লয়।। একদিন সে তারক ভাবে মনে মন। টাকা কড়ি হাতে নাই কি করি এখন।। গৃহেতে তণ্ডুল নাস্তি মনেতে জানিয়া। কি করিবে কোথা যাবে, না পায় ভাবিয়া।। মনে মনে সে তারক ভাবিল হৃদয়। বাকি মাছ কিনে লভ্য হইবে নিশ্চয়।। লোহাগড়া হাটে যায় ঝাকা ডালা লয়ে। মাছ কিনে বেচিবে সে কাটিয়ে কাটিয়ে।। হরিচাঁদ রূপ চিন্তা করিতে করিতে। উপনীত হইল গিয়ে মাছ হাটেতে।। এক দোকানেতে দেখে বড় এক মাছ। তাই দেখে মনে মনে ভাবে রসরাজ।। বড় এক রুই মাছ দেখিয়া নয়নে। হরিচাঁদ রূপ চিন্তা জাগে তার মনে।। মনে মনে ভাবিতেছে কবি রসরাজ। হরি যদি খাইতেন এই রুই মাছ।। মনের বাসনা মোর হইতো সফল। ভাবনার সাথে সাথে ঝরে আখি জল।। যাহার দোকানে এই রুই মাছ ছিল। তাহার পিছনে গিয়া তারক দাড়াইল।। সে মাছের খরিদ্দার ছিল বহু জন। নয় শিকা মূল্য তারা কহিল তখন।। তারক তথন গিয়ে দাড়াইল পাশে। সে মাছের খরিদ্দার কেহ নাহি আসে।। বেলা গেল সন্ধ্যা হল এমন সময়। মাছের দোকান দার তারকেরে কয়।। মাছ তুমি নিবে নাকি শুন ওরে ভাই। তারক বলেছে মোর কাছে টাকা নাই।। বাকি যদি দাও ভাই তবে নিতে পারি। হাট শেষে দিব টাকা মাছ বিক্রি করি।। তাই শুনে সে বেচারা কহিল তখন। মাছ বেচে দিও টাকা সময় মতন।। তারক বলেছে তুমি কত মূল্য লবে। সে বলেছে তুমি নিলে পাঁচ শিকা দিবে।। তখনি তারক চন্দ্র সেই মাছে নিয়ে। বটি দিয়ে অর্ধ অংশ ফেলিল কাটিয়ে।। মাথা সহ সেই ভাগ ঝাকা মধ্যে রাখি। সাবধানে রাখিলেন ডালা দিয়ে ঢাকি।। বাকি অংশ কেটে কেটে ভাগ সাজাইল। এমন সময় এক খরিদ্দার এল।। সে বলেছে আমি তব সব মাছ লব। এক কথা বল তুমি কত মূল্য দিব।। তারক বলেছে যদি সব মাছ নিবে। এ মাছের মূল্য মোরে পাঁচ শিকা দিবে।। তাহা শুনি খরিদ্দার পাঁচ শিকা দিয়ে। বিদায় হইল তিনি সেই মাছ নিয়ে।। এমন সময় এল পূর্ব মহাজন। তারকেরে ডেকে বলে মধুর বচন।। শুন শুন ও তারক মোর দাম দাও। আমি এবে ঘরে যাব দেনা শোধ হও।। অমনি তারক চন্দ্র পাঁচ শিকা দিল। মূল্য লয়ে সে বেচারা বিদায় হইল।। অমনি তারক চন্দ্র ভাবিতে লাগিল। হরিচাঁদ ছবি খানি মনেতে জাগিল।। প্রেমে পুলকিত চিত্ত কবি রসরাজ। মনে ভাবে এই বুঝি ঠাকুরের কাজ।। ভক্ত বাঞ্ছা কল্পতরু হরি দয়াময়। জানিয়া ভক্তের মন এ খেলা খেলায়।। আনন্দেতে আত্মহারা ভাবেতে বিভোলা। মস্তকে করিল সে, সে মাছের ডালা।। হরিচাঁদ রূপ চিন্তা করিতে করিতে। প্রেমে গদ গদ চিত্তে লাগিল হাটিতে।। চলেছেন রসরাজ ওড়াকান্দি পথে। ঘোর অন্ধকার রাত্রি কেহ নাই সাথে।। হরিচাঁদ রূপ চিন্তা করিতে করিতে। প্রেমে পুলকিত চিত্ত চলেছেন পথে।। মনে ভাবে ওগো প্রভু তুমি দয়াময়। কামনার ফল তুমি দিয়েছ আমায়।। দয়া করে নিও প্রভু তোমার নিকটে। হেন কালে উপনীত তারাইল ঘাটে।। মধুমতি নদী তাহে খরস্রোত বয়। খেয়াঘাটে খেয়া নাই কি হবে উপায়।। রাত্রি কালে খেয়া নৌকা এপারে না থাকে। সন্ধ্যা হলে নৌকা খানি ও পারেতে রাখে।। পূর্ব পারে পাটনীর বাড়ী ঘর ছিল। খেয়া তরী ঘাটে বেধে গৃহেতে রহিল।। পশ্চিম কুলেতে বসে তারক রসনা। ডাকি ডাকি কারিতেছে কেহ তা শোনে না।। মনে মনে ভাবিতেছে ভক্ত চূড়ামণি। নিরাশা পাথারে কেনে ভাসালে তরণী।। মনে বড় আশা ছিল কামনার ফল। তোমাকে খাওলে হবে জীবন সফল।। সে বাসনা আজি মোর না হল পুরণ। বুঝিলাম দয়াময় আমি অভাজন।। আমি অতি মুঢ় মতি ওগো দয়াময়। সে কারণে খেয়া ঘাটে ঠেকিলাম দায়।। এত ভাবি সে তারক কান্দিতে লাগিল। হরিচাঁদ রূপ চিন্তা হৃদয়ে জাগিল।। চক্ষু যদি বসিলেন নদীর কিনারে। মহাভাব উথলিয়া ভাসে আখি নীরে।। খেয়া ঘাটে বসে আছে সমাধির প্রায়। মন পাখি উড়ে গেল ঠাকুরের পায়।। একে ভীষণ শীত তাহে নদী কুল। তারকের গায়ে শীত নাহি এক চুল।। ও দিকে তে হরিচাঁদ প্রভু দয়াময়। শয়ন করিয়া আছে কোমল শয্যায়।। আচম্বিত শয্যা হতে নিদ্রা ভঙ্গ হল। থর থর মহাপ্রভু কাপিতে লাগিল।। ভক্ত বাঞ্ছা কল্পতরু দয়াময় হরি। তারকের গাত্র শীত নিজ দেহে ধরি।। ছট ফট করিতেছে শয্যার উপরে। তাহা দেখি শান্তিদেবী কহে ধীরে ধীরে।। ওগো প্রভু কি হইল বল গো আমায়। ছট ফট কেন কর ওগো দয়াময়।। তাহা শুনি বলেছেন দয়াময় হরি। শীতে ভীষণ জ্বালা সহিতে না পারি।। হস্ত পদ ঠান্ডা হয়ে গিয়াছে আমারি। কহ কহ কহ প্রিয়ে কি করি এবার।। তাহা শুনি শান্তি দেবী লেপ কাথা আনি। ঠাকুরের দেহ পরে দিলেন তখনি।। যত দেয় লেপ কাথা তত শীত বাড়ে। তাহা দেখে শান্তি দেবী ডাকে গোলোকেরে।। গোলক পাগল ছিল বাহির বাটিতে। মায়ের ব্যাকুল স্বর শুনিল কানেতে।। ব্যাস্ত হয়ে সে গোলক আসিল তথায়। মহাপ্রভু কাপিতেছে দেখিবারে পায়।। গোলোক বলেছে বাবা কি খেলা তোমার। তব লীলা বুঝিবারে কি সাধ্য আমার।। তুচ্ছ শীত লাগি কেন কাঁপিতেছ তুমি। সকল সহিতে পার ওগো বিশ্ব স্বামী।। এত কেন উচাটন দেখি যে তোমায়। কহ কহ কহ প্রভু ধরি তব পায়।। গোলোকের বাক্য শুনে হরি চাঁদ বলে। সকল সহিতে পারি নিজ অঙ্গে হলে।। কিন্তু যদি ভক্ত অঙ্গে কোন কিছু হয়। সে সব সহিতে নারি এই দুনিয়ায়।। আমার ভক্তের ব্যাথা সহিতে না পারি। ভক্ত অঙ্গ যত কিছু নিজ দেহে ধরি।। যদি কোন ভক্ত মোরে দেহ করে দান। শীত গ্রীষ্ম সহ্য করি যদি যায় প্রাণ।। আজি মোর প্রাণাধিক তারক রসনা। মধুমতি কুলে বসে কান্দে মোর সোনা।। পার হতে না পারিয়া রয়েছে বসিয়ে। শীতের তাপেতে অঙ্গ গেছে ঠান্ডা হয়ে।। তার দেহ মোর দেহ ভিন্ন কিছু নয়। তার দেহে যত শীত আমাতে উদয়।। শুনরে গোলোক তুমি মোর কথা লও। তারকে আনিয়া মোর পরাণ বাঁচাও।। সেই মোর প্রাণাধিক পোষা শুক পাখি। জীবন চঞ্চল হয় তাহারে না দেখি।। ঠাকুরর বাক্য শুনে গোলকে গোঁসাই। বলে বাবা চলিলাম কোন চিন্তা নাই।। জয় হরি বল মন গৌর হরি বলে। অন্ধকার রাত্রি সেথা একা একা চলে।। চলেছেন ভক্ত বীর অনুরাগ ভরে। দেখিতে দেখিতে গেল মধুমতী তীরে।। খেয়া তরী ঘাটে বাঁধা দেখিতে পাইয়া। আপনি চলিল সেই তরণী বাহিয়া।। ওপারেতে গিয়ে সেই গোঁসাই গোলোক। বারে বারে ডাকিতেছে তারক তারক।। তারক বসিয়া ছিল সমাধির প্রায়। গোলোক চাঁদের ডাক শুনিবারে পায়।। তখনি তারক চন্দ্র চরণে পড়িল। চরণ ধরিয়া শেষে কান্দিতে লাগিল।। কেন্দে কেন্দে বলিতেছে আধ আধ ভাস। কি লাগিয়া এলে দাদা কর হে প্রকাশ।। তারকের বাক্য শুনে গোলোক বলেছে। এই মাত্র ছিনু আমি ঠাকুরের কাছে।। ঠাকুরের আজ্ঞা নিয়া এসেছি রে ভাই। তোর মত হরিভক্ত এ জগতে নাই।। তোর লাগি বাবা আজি ওড়াকান্দি বসে। ছট ফট করিতেছে আখি জলে ভেসে।। তারক তারক বলে ছাড়িতেছে হাই। তাই দেখে তোকে নিতে এসছিরে ভাই।। হরিচাঁদ পোষা পাখি তুই মোর সোনা। ভক্তাধীন ভগবান এবে গেল জানা।। তোর দেহে যত শীত ধরে ভগবান। তারক তারক বলে হতেছে অজ্ঞান।। চল তোকে লয়ে যাই ঠাকুরের কাছে। তুই গেলে ঠাকুরের সব জ্বালা ঘোচে।। তারক বলিছে দাদা কি কথা কহিলে। বলিতে বলিতে তথা মুর্ছিত হইলে।। মুখেতে নাহিক ভাষা কান্দে ফুকারিয়ে। অমনি গোলোক চন্দ্র ধরিল জড়ায়ে।। কোলে করে তারকেরে নৌকায় তুলিল। সে মাছের ডালা শেষে মস্তকে করিল।। নিজ তাতে শ্রী গোলোক বাহিলেন দাড়। মুহুর্তের মধ্যে নদী হইলেন পার।। তারকের কোলে করি চলিল অমনি। মস্তকে মাছের ঝাকা আশ্চর্য্য কাহিনী।। চলেছেন ভক্তবীর অনুরাগ ভরে। হরিচাঁদ ছবি খানি রাখিয়া অন্তরে।। যেদিন গন্ধমাদন আনে হনুমান। তেমনি গোলোক চন্দ্র চলেছে ধীমান।। মুহেুর্তেকে উতরিল ওড়াকান্দি গাঁয়। ঠাকুরের কাছে নিয়ে হইল উদয়।। অমনি দয়াল হরি বাহু প্রসারিয়া। তারকেরে বক্ষে ধরে কহিছে কান্দিয়া।। তুই মোর প্রাণাধিক ওহে বাছাধন। তোরে না দেখিলে মোর বাঁচে না জীবন।। তোরে বিনে এ জীবনে কোন শান্তি নাই। তোর মত ভক্ত যেন যুগে যুগে পাই।। পরশমণির স্পর্শ তারক পাইয়া। চৈতন্য হইয়া কান্দে পদেতে পড়িয়া।। এ দীন বিনোদ বলে ওপদ লাগিয়া। জনম চলিয়া গেল কান্দিয়া কান্দিয়া।। তারকের স্তব (লঘু ত্রিপদী) ওগো দয়াময় হইয়া সদয় করুণা করিলে মোরে। গুণের মহিমা, দিতে নারি সীমা নাম নিলে আখি ঝরে।। আমি অন্ধ জন না জানি সাধন তোমারি কৃপা গুণে। আসিয়া ধরায়, চিনিনা তোমায় ভুলিয়া মায়া বন্ধনে।। তুমি দীনবন্ধু করুণার সিন্ধু পতিত পাবন হরি। পতিত তারিতে এলে অবনিতে সাঙ্গ পাঙ্গ সঙ্গে করি।। তুমি দর্প হারী, মুকুন্দ মুরারী প্রভু নিত্য নিরঞ্জন।। তুমি চক্র ধারী সুন্দর শ্রী হরি ভকত নয়নমণি। অগতির গতি তুমি শান্তি পতি কন্যা তব এ ধরণী।। অন্ধের নয়ন মহা উদ্ধরণ তিমির বিনাশকারী। মদন মোহন ভকত জীবন দুষ্টের দমন হরি।। তং হি পূর্ণব্রহ্ম তুমি হে আব্রহ্ম কৃষ্ণ কেশব শ্রী রাম। দেব গদাধর গৌরাঙ্গ সুন্দর গুণময় গুণধাম।। বিধাতার বিধি তুমি গুণনিধি সর্ব গুণের আধার। অন্তিম কাণ্ডারী দিতে পদতরী ভব নদী কর পার।। ভকত লাগিয়া বেড়াও কান্দিয়া ব্যাথায় বেথিত হয়ে। তুমি বিনে আর কে আছে আমার ফেল না পদে ঠেলিয়া।। (পয়ার) ভক্তি ভাবে স্তুতি করে তারক রসনা। ঠাকুর বলে বাছা তুই মোর সোনা।। পদ্ম হস্ত বুলায়েছে তারকের গায়। হেনকালে শান্তি মাতা আসিল তথায়।। তারকেরে কোলে করি মাতা ঠাকুরাণী। ছল ছল আখি দু’টি কহিতেছে বাণী।। তুই মোর প্রাণাধিক ওহে বাছাধন। বহু দিন হেরি নাক ও চাঁদ বদন।। চাঁদ মুখে চুমু দেয় জগত জননী। ধন্য ধন্য শ্রী তারক কবি চূড়ামণি।। দেখরে নগর বাসী দেখরে চাহিয়া। হেন ভাগ্য কার হয় জনম লভিয়া।। ভক্ত আর ভগবান এমতি মিলন। মনে হয় এই যেন বৈকুন্ঠ ভুবন।। এই ভাবে ভক্ত আর হরি দয়াময়। প্রেম সকরান্ধ পানে প্রফুল্ল-হৃদয়।। (মকরন্দ) ধীরে ধীরে হরিচাঁদ কহিল তখন। শুন শুন শান্তি দেবী আমার বচন।। তারকের আনা মাছ কর হে রন্ধন। বড় ক্ষুধা লাগিয়াছে করিব ভোজন।। তাই শুনি শান্তি দেবী করিল রন্ধন। ভক্তের ভক্তির দ্রব্য হইল তেমন।। রন্ধন করিয়া দেবী কহিল তখন। সবাই বস রে খেতে হয়েছে রন্ধন।। তাই শুনি হরিচাঁদ ভোজনে বসিল। তারক গোলোকে দুই পাশেতে বসাল।। ভক্ত আর ভগবানে করেছে ভোজন। শান্তি মাতা অন্ন দেয় আনন্দিত মন।। হরিচাঁদ বলে বড় সুন্দর রন্ধন। এমন স্বাদের মাছ খাইনি কখন।। তাই শুনি সে তারক ভাবে মনে মনে। আজি মোর মনবাঞ্ছা হইল পূরণ।। হরি হরি হরি বলে কান্দিছে তারক। তাই দেখে হরি বলে নাচিছে গোলক।। ভক্ত আর ভগবান এমতি মিলন। হয় নাই হবে নাক এ তিন ভুবন।। এ দীন বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে। হরিচাঁদ ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।। তাই বলি ভাই সব বেলা বেশী নাই। হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরিবল ভাই।। তারকের ভ্রান্তি দুর সেই হতে কিছুদিন ওড়াকান্দি রয়। ঠাকুরের কর্ম করে হরি গুণ গায়।। এই ভাবে দশ দিন গত হয়ে গেল। নিজের বাড়ীর কথা মনে যে পড়িল।। ভাবিলেন ঘরে মোর অর্থ কিছু নাই। কিভাবে বাঁচিবে সবে মনে ভাবে তাই।। ভাবিতে ভাবিতে তার ঝড়ে আখি জল। অন্তরে জানিল তাহা পরম দয়াল।। তারকের কাছে গিয়ে হরিচাঁদ কয়। শুন শুন ও তারক বলি যে তোমায়।। গৃহে চেল যাও তুমি ওহে বাছাধন। ভক্তি পথে থাকে যেন সদা তব মন।। যে করে আমার চিন্তা তার চিন্তা নাই। তার দৈন্য দশা আমি সকল ঘুচাই।। তাই শুনি সে তারক প্রণমিল পায়। ঠাকুরের পদধুলি লইল মাথায়।। শান্তি মার পদ প্রান্ত প্রণাম করিয়া। ছল ছল আখি দু’টি কহিছে কান্দিয়া।। তব চরণেতে মাগো এই ভিক্ষা চাই। জনমে জনমে যেন ভুলিয়া নাই যাই।। শান্তি মাতা কহিলেন শুন বাছাধন। তোমার মনের বাঞ্ছা হইবে পুরণ।। আশীর্বাদ লয়ে শিরে তারক সুজন। ওড়াকান্দি হতে যাত্রা করিল তখন।। পথে যেতে কত কিছু ভাবিতে লাগিল। গৃহের সকল কথা মনেতে পরিল।। ঘরেতে তণ্ডুল নাস্তি কি হবে উপায়। নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।। দশ দিন গত হল উপায় কি হবে। অন্য বিনে মাতা মোর না খেয়ে মরিবে।। যোগ্য পুত্র বেঁচে থেকে মায়ের মরণ। ধিক ধিক শত ধিক আমার জীবন।। দশ মাস দশ দিন জঠরে ধরেছে। নিজে না খাইয়ে মাতা কত কি করেছে।। ইতি উতি কত কিছু ভাবিতে ভাবিতে। জলে ভরা আখি দু’টি লাগিল হাটিতে।। বেলা গেল সন্ধ্যা হল এমন সময়। লোহাগড়া বাজারেতে হইল উদয়।। হরিচাঁদ ছবিখানি হৃদয় ধরিয়া। গৃহের পিছনে গিয়া রহিল বসিয়া।। তারকের মাতা বলে বধুমাতা ঠাই। শুন শুন বধুমাতা তোমাকে জানাই।। ওড়াকান্দি গেছে সে তারক আমার। দশ দিন গত হল না জানি ব্যাপার।। তারকের লাগি মোর পরাণ কেন্দেছে। কি যেন কি হল নাকি মনেতে জেগেছে।। চিন্তামণি বলে মাগো কোন চিন্তা নাই। অদ্য কিবা কল্য আসে মনে জাগে তাই।। ওড়াকান্দি হরিচাঁদ বড় দয়াময়। তার কাছে গেলে পরে বিপদ না হয়।। বিপদ ভঞ্জন হরি জগতে আসিল। হরি নামে পাপ তাপ সকল নাশিল।। আমাদের ভাগ্য ভাল পেয়েছি চরণ। জনমের মত আজি লইনু শরণ।। হেন কথা যখনেতে তারক শুনিল। মায়ের চরণে এসে প্রণাম করিল।। ছল ছল আখি দু’টি কহিলেন বাণী। কি ভাবে বাঁচিয়া র’লে বল তাই শুনি।। গৃহেতে তণ্ডুল নাস্তি গেলাম রাখিয়া। কোন ভাবে কি খাইয়া রহিলেন বাঁচিয়া।। দশ দিন গত হল আমি বাড়ী নাই। চাউল কোথায় পেলে বল শুনি তাই।। তারকের মাতা বলে কি কথা কহিলি। হাট থেকে চাল কিনে তুই যে পাঠালি।। সুন্দর বালক এক আসি হেথায়। চাউল ডাউল দিয়া হইল বিদায়।। সে বলিল তারক সে ওড়াকান্দি গেছে। মোর কাছে চাল কিনে পাঠিয়ে দিয়েছে।। তারে কোন দিন আমি চোখে দেখি নাই। ভাবিলাম তোর কাছে জিজ্ঞাসিব তাই।। হেন বাক্য যখনেতে তারক শুনিল। মায়ের চরণ ধরি কান্দিতে লাগিল।। কেন্দে বলে ওগো মাতা বলি তব ঠাই। কারো কাছে চাল কিনে আমি দেই নাই।। এমন বান্ধব কেবা আছে এ জগতে। চাউল ডাউল দেয় বয়ে মস্তকেতে।। আমি অতি মুঢ়মতি কোন গুণ নাই। কেবা এই মহাজন মনে ভাবি তাই।। হেন বাক্য যখনেতে তারক বলিল। চিন্তামণি পদে পড়ে কান্দিতে লাগিল।। কেন্দে বলে ওগো স্বামী বলি তব ঠাই। কেবা এসেছিল আমি তোমাকে জানাই।। মনে পরে এসেছিল হরি দয়াময়। তাহাকে দেখিয়া চক্ষু ফিরান না যায়।। সুন্দর বালক রূপে এসেছিল হেথা। হেন রূপ আমি আর দেখি নাই কোথা।। আমি তারে জিজ্ঞাসিনু কোথা বাড়ী ঘর। সে বলিল আমি থাকি বাজারের পর।। ভাবের বাজারে থাকি মোট বয়ে খাই। যে আমায় মোট দেয় তার বাড়ী যাই।। আমাদের বোঝা তিনি মস্তকেতে করি। ছদ্মবেশে এসছিল দয়াল শ্রী হরি।। হেন বাক্য চিন্তামণি বলিতে বলিতে। তারকের পদে পড়ে লাগিল কান্দিতে।। তারক ঢলিয়া পল মায়ের চরণে। শত বারী বহিতেছে তাহার নয়নে।। দেখরে জগত বাসি দেখরে চাহিয়া। কি ভাবে কি করে হরি ভক্তের লাগিয়া।। যদি কোন ভক্ত তারে সব কিছু দেয়। এই ভাবে হরি তার বাসনা পুরায়।। তাই বলি ভাই সব আর কিবা চাও। শ্রীহরির শ্রীচরণে সব সপে দাও।। কান্দিয়া বিনোদ বলে বেলা বেশী নাই। হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।। ভক্তের বাধ্য হরিচাঁদ লাল চন্দ্র পুর গ্রাম খুলনা জেলায়। কবিগান হবে সেথা জানিল সবায়।। কালীকৃষ্ণ নামে এক জমিদার ছিল। তার বাড়ী কবিগান বন্দোবস্ত হল।। তারক গোঁসাই এল গান গাহিবার। মথুর নামেতে এল অন্য সরকার।। দুই দলে হবে সেথা কাব্য আলোচনা। দলে দলে সবে এল শুনিতে বাসনা।। বহু লোক এলা তথা গান শুনিবারে। দুই দল উঠিলেন কবির আসরে।। ভবানী বিষয় আর আগমনী হয়। সখী সংবাদ কবি যে হয়ে গেল সায়।। তারপর পাঁচালীতে গেল দুই জন। গান শুনে আনন্দিত সবাকার মন।। মথুর সাজিল গিয়ে কেশব কাশ্মীরী। তারকেরে সাজাইল শ্রীগৌরাঙ্গ হরি।। কেশব কাশ্মীরী শেষে কহিতে লাগিল। তুমি নাকি ভগবান লোকে তাই বলে।। তুমি যদি ভগবান বলি যে তোমায়। হরি নামে মাতোয়ারা সকল সময়।। দু’টি কথা বলি তোমা শুন দিয়া মন। বৃন্দাবনে তুমি যবে করিলে ভ্রমণ।। হরি নামে মাতোয়ারা ঝরে দু’টি আখি। হেন কালে দুই হাতে পড়ে দুই পাখী।। শুক আর সারী এই পাখী দুইজন। দুই শ্লোক বলে তারা কিসের কারণ।। শ্লোক দু’টি বল আজি এ সবার মাঝ। তবে আমি বুঝে লব তুমি রসরাজ।। শ্লোকের অর্থ কিবা বল ভগবান। প্রাণ ভরে শুনে আমি জুড়াইব কান।। তারপর শ্রী তারক আসরেতে যায়। শ্লোকের অর্থ কিবা খুঁজিয়া না পায়।। ধামা চাপা দিয়ে বলে তারক গোঁসাই। হরি নামে মাতোয়ারা শুনিতে না পাই।। তারপর সে মথুর আসরেতে যায়। ব্যাঙ্গ করে তারকেরে কত যে কি কয়।। তাই শুনে সে তারক বাহিরেতে গেল। নয়নের জলে বক্ষ ভাসিতে লাগিল।। নির্জনে বাসিয়া কবি ভাবে মনে মন। কোথা প্রভু হরিচাঁদ কি করি এখন।। তোমার আদেশ নিয়া কবিগান গাই। তোমার কৃপায় কোথা পরাজয় নাই।। এবে তুমি বলে দাও কি হবে উপায়। তোমার নামের বুঝি হয় পরাজয়।। সাধন না জানি প্রভু ভজন না জানি। এ বিপদে রক্ষা কর হরি গুণমণি।। তুমি যারে রক্ষা কর ওগো দয়াময়। তার কভু নাহি হয় হেন পরাজয়।। মহাভাব উথলিয়া আখি দু’টি ঝরে। ওড়াকান্দি থেকে হরি জানিল অন্তরে।। ভক্তের লাগিয়া আজি হরি দয়াময়। কাগজেতে শ্লোক লিখে বাতাসে ভাসায়।। বাতাসেতে ভেসে ভেসে সে কাগজ খানি। তারকের মস্তকেতে পড়িল অমনি।। তাই দেখে সে তারক কাগজ ধরিল। দুই শ্লোক লেখা আছে দেখিতে পাইল।। মনে মনে ভাবিতেছে কবি রসরাজ। ভক্ত বাঞ্ছাকল্পতরু তার এই কাজ।। তখনি তারক চন্দ্র আসরেতে যায়। শোক দু’টি ব্যাখ্যা করি সবারে জানায়।। কবির খোলায় যত শ্রোতাগণ ছিল। আনন্দেতে আত্মহারা প্রেমেতে ভাসিল।। (শ্লোকের অর্থ) যাহার সৌন্দর্য দেখে ললনা ভুলিল। স্ত্তম্ভবিধায়িনী রাধা প্রেমেতে মজিল।। যেই প্রভু গোবর্ধন করিল ধারণ। তাই দেখে জনগণ আনন্দিত মন।। বিশ্বজন হিত লাগি মদন মোহন। বিশ্বের মঙ্গল করে সেই কৃষ্ণধন।। শ্রীরাধার প্রেম আর নত্তন কীর্তন। শ্রীকৃষ্ণের করিলেন চিত্ত আকর্ষণ।। এত বলি শ্রীতারকে ব্যাখ্যা যে করিল। শ্রোতাগণ সুখী হয়ে আনন্দে ভাসিল।। জয় জয় ধ্বনি ওঠে আকাশ ভেদিয়া। রমাগণে উলুধ্বনি দিলেন আসিয়া।। গান শেষে সে তারক বাহিরেতে এল। শত শত শ্রোতাগণ চরণে পড়িল।। তারকের জয়গান করিতে করিতে। শ্রোতাগণ চলে গেল যে যার বাটিতে।। গান শেষে সব দল বিদায় হইল। যার যার দেশে সবে গমন করিল।। তারপর সে তারক ওড়াকান্দি যায়। প্রণাম করিল গিয়ে ঠাকুরের পায়।। কেন্দে কেন্দে সে তারক বলিল বচন। সেই শ্লোকের কথা কহিল তখন।। তারকের কথা শুনে হরিচাঁদ কয়। ভক্ত বাঞ্ছা পুরাইতে আসি এ ধরায়।। তোর পরাজয় দেখে শ্লোক লিখিয়া। পবনের কাছে আমি দেই পাঠাইয়া।। হেন বাক্য হরিচাঁদ যখন বলিল। তারক চরণে পড়ে কান্দিতে লাগিল।। তারকের কান্না দেখে বলে দয়াময়। আশীর্বাদ দিয়ে তারে করিল বিদায়।। কান্দিয়া বিনোদ বলে বেলা বেশী নাই। হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।। মতির ফাঁশি মুক্তি হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ। হরিভক্ত গুণ কথা করিব বর্ণন।। কালিয়া থানার মধ্যে রায়পুর গ্রাম। সেই গ্রামে বাস করে মতিচন্দ্র নাম।। স্বাভাবিক ভাবে তার জীবন চলিত। মাঝে মাঝে সেই গ্রামে তারক আসিত।। তারকেরে ভক্তি করি জীবন কাটায়। কৃষি কার্য্য করিতেন সেই মাহাশয়।। একদিন সেই মতি জমি চষিবারে। মাঠ মধ্যে চলিলেন হাল স্কন্ধে করে।। সে জমির আর নিয়ে গোলমাল ছিল। সেই দিন তার সঙ্গে কোন্দল বাঁধিল।। দুই জন হাতা হাতি মারামারি করে। ক্রোধ ভরে সেই মতি বাড়ী দেয় তারে।। হালুয়া লাঠির বাড়ী মস্তকেতে দিল। নাকে মুখে রক্ত উঠে মাটিতে পড়িল।। ছট ফঠ করি শেষে জীবন ত্যাজিল। তাই দেখে সেই মতি ভয়ে পালাইল।। মাঠ ভরা কৃষকেরা ছুটিয়া আসিল। মরা শব লয়ে তারা থানায় চলিল।। খুনি কেচ লিখে সেই দারগা তখন। কোটেতে পাঠায় কেচ করিয়া যতন।। শমন করিযা জারী মতিকে ধরিল। হাত কড়া দিয়ে তারে জেলেতে পুরিল।। জেলেতে থাকিয়া মতি ভাসে আখি জলে। কি হইতে কি হইল মনে মনে বলে।। সত্য সত্য স্বাক্ষী পেয়ে হাকিম তখন। জজ কোর্টে পাঠাইল করিয়া লিখন।। জজ বাবু স্বাক্ষী পেয়ে হুকুম করিল। সে মতির ফাঁশি হয়ে রায়েতে লিখিল।। ফাঁশির হুকুম হল শুনে মতি শেষে। কান্দিতে লাগিল মতি আখি জলে ভাসে।। পরিবারসহ কান্দে সে কথা শুনিয়া। হায় হায় কি হইল না পায় ভাবিয়া।। সে মতির ফাঁশি হবে সকলে শুনিয়া। যার যার মন কথা বেড়ায় বলিয়া।। ফাঁশির হুকুম হল আইন ধারায়। তিন সত্ত্বা মধ্যে তার এক সত্ত্বা পায়।। কাউকে দেখিতে ইচ্ছা যদি থাকে মনে। কোন দ্রব্য খেতে ইচ্ছা থাকে তার মনে।। মানিতে ছাপাই স্বাক্ষী মনে যদি চায়। মানিলে মানিতে পারে আইনেতে কয়।। তাই শুনে সেই মতি মানিল ছাপাই। আমার ছাপাই স্বাক্ষী তারক গোঁসাই।। সেই ভেবে সেই মতি তারকে স্মরিয়া। তারকের ছবি খানি হৃদয়ে ধরিয়া।। আখি জলে ভেসে ভেসে কেন্দে ছাড়ে হাই। অন্তিমের ইচ্ছা আমি তোমাকে জানাই।। সে মতির ইচ্ছা যাহা জজ বাবু শুনে। নোটিশ লিখিয়া দিল পিওনের স্থানে।। পিওন নোটিশ লয়ে তারকে জানায়। তারক জানিয়া তাহা ভাবিল হৃদয়।। লোক মুখে শুনিয়াছি খুনের ঘটনা। কেমনেতে দিব স্বাক্ষী কিছু ত জানি না।। মতি মোরে স্বাক্ষী মানে কী মনে ভাবিয়া। কেমনেতে দিব স্বাক্ষী জজ কোর্টে গিয়া।। ইতি উতি কতকিছু মনেতে ভাবিল। স্বাক্ষীর তারিখ দিনে কোর্টে নাহি গেল।। তারপর জজ বাবু শমন পাঠায়। পিওন আসিয়া সেই শমন দেখায়।। পিওন বলেছে তুমি শুন মহাশয়। এ তারিখে নাহি গেলে বিপদ নিশ্চয়।। কোর্টের অমান্য হবে স্বাক্ষী যায় জেলে। শুন শুন মহাশয় আমি যাই বলে।। এই কথা বলে তিনি করিল গমন। তাই শুন রসরাজ ভাবে মনে মন।। মতি মোরে ভক্তি করে চিরদিন জানি। সত্য সত্য অপরাধি লোক মুখে শুনি।। কি করিব কোথা যাব ভাবিয়া না পাই। কোথা মোর হরিচাঁদ তোমাকে জানাই।। তুমি যারে রক্ষা কর ওগো দয়াময়। জীবনে মরণে তার নাহি কোন ভয়।। হরিচাঁদ ছবিখান হৃদয়ে ধারিয়া। নিশ্চিত শয়ন করে শ্রীহরি স্মরিয়া।। স্বপনেতে সে তারক দেখিতে পাইল। দয়াময় হরিচাঁদ কহিতে লাগিল।। শুন শুন বাছাধন বলি যে তোমায়। স্বাক্ষী দিতে চলে যাও নাহি কোন ভয়।। যেই খানে তুমি যাবে সঙ্গে সঙ্গে রব। তোমার মনে বাঞ্ছা আমি পুরাইব।। স্বপনে দেখিয়ে সেই তারক সুজন। ভাবে গদ গদ চিত্ত ঝরে দুনয়ন।। হরিচাঁদ ছবি খানি হৃদয় ধরিয়া। কোর্টের সমীপে গিয়ে রহিল বসিয়া।। হরিচাঁদ লীলা খেলা কে বোঝে ধরায়। কার দ্বারা কিবা করে হরি দয়াময়।। জজের জীবন কথা শুন দিয়া মন। ঘটনা প্রবাহ আজ করিব বর্ণন।। বিবাহ করেছে মাত্র সন্তান না হয়। জজের রমনী কান্দে সেই বেদনায়।। নিদ্রা যোগে সে রমনী দেখিতে পাইল। হরিচাঁদ এসে তারে কহিতে লাগিল।। শুন শুন শুন মাগো বলি যে তোমায়। তোমার লাগিয়া আমি এসেছি হেথায়।। তারক নামেতে মোর ভক্ত একজন। আগামী সকালে এসে দিবে দরশন।। জজ কোর্টে স্বাক্ষী দিতে আসিবে সে জন। তাহার বরেতে হবে তোমার নন্দন।। যদি তারে ভক্তি করি আনিবে হেথায়। মন বাঞ্ছা পূর্ণ হবে তাহার দ্বারায়।। হেন কথা হরিচাঁদ যখনে কহিল। নিদ্রা ভেঙ্গে সেই নারী কান্দিতে লাগিল।। স্বামীর চরণ ধরে কেন্দে কেন্দে কয়। স্বপ্নের বৃত্তান্ত কথা সকল জানায়।। তাই শুনে জজ বাবু আখি জলে ভাসে। কিছু কাল মৌন হয়ে রহিলেন বসে।। মনে মনে ভাবিলেন এ সত্য ঘটনা। স্বাক্ষীর ঘটনা মোর নারী ত জানেনা।। নিশ্চই স্বপনে এসে কহিলেন হরি। তারকেরে আনিবারে করিব না দেরি।। এত বলি দুই জন পুলিশ ডাকিয়া। তারকেরে আনিবারে দিল পাঠাইয়া।। পুলিশ দুজন গিয়ে খুঁজিতে লাগিল। কোর্টের কাছেতে গিয়ে দেখিতে পাইল।। মৌন হয়ে বসে আছে তারক সুজন। তারকেরে দেখে তারা কহিল তখন।। তার নাম কিবা হয় বল মহাশয়। এই খানে বসে আছে কিসের আশায়।। তারক আমার নাম কহিল তখন। স্বাক্ষী দিতে আসিয়াছি শুন বিবরণ।। তাই শুনি পুলিশেরা কহিল তখন। জজ বাবু ডাকিতেছে তোমারে এখন।। জজের আদেশে মোরা আসিয়াছি নিতে। এখন যাইতে হবে আমাদের সাথে।। তারক বলেছে আমি এই খানে রব। ডাক হরে স্বাক্ষী দিয়ে গৃহে চলে যাব।। পুলিশ বলেছে তুমি বোকা মন্দ নও। জজ বাবু ডাকিতেছে বুঝিতে কি পাও।। তারক বলেছে আমি বুঝি না কখন। হোক সে জজ বাবু যাব না এখন।। তাই শুনে পুলিশেরা হইল বিদায়। জজের কাছেতে গিয়ে সকল জানায়।। তারক বলিল আমি এই খানে রব। হোক সে জজ বাবু আমি না যাইব।। তাই শুনে বলিতেছে জজের রমনী। ছল ছল আখি দু’টি কহিছে তখনি।। স্বামীর চরণ ধরি কেন্দে কেন্দে কয়। শুন তুমি ওগো স্বামী বলি যে তোমায়।। সে মানুষ আনিবারে কর হে গমন। কেন্দে কেন্দে সে রমনী কহিল তখন।। তাই শুনে দুই জন গমন করিল। তারকের কাছে গিয়ে উপস্থিত হল।। তারকের পদে পড়ে কেন্দে কেন্দে কয়। আমাদের গৃহে চল ধরি তব পায়।। কান্না দেখে কহিলেন তারক গোঁসাই। স্বাক্ষী দিতে আসিয়াছি কেমনেতে যাই।। তাই শুনে জজ বাবু কান্দিয়া বলেছে। গত রাত্রে তব স্বাক্ষী হইয়া গিয়াছে।। দয়া করে চল বাবা আমাদের ঘরে। বলিতে বলিতে তার আখি দু’টি ঝরে।। কেন্দে কেন্দে দুই জনে পড়িল ধরায়। তারকের পদে পড়ে গড়াগড়ি যায়।। তাই দেখে তারকের দয়া উপজিল। দুজনার ধরে তুলে কহিতে লাগিল।। চল চল জজ বাবু তব ঘরে যাই। বিলম্ব সহিতে নারি তোমাকে জানাই।। এত বলি চলিলেন জজের বাসায়। কেন্দে কেন্দে সেই নারী চরণ ধোয়ায়।। চরণ ধোয়ায়ে শেষে আসনে বসায়। আখি জলে ভেসে ভেসে কেন্দে কেন্দে কয়।। স্বপনেতে দেখিয়াছি অপূর্ব মুরতী। শিয়রে বসিয়া মোরে কহিল ভারতী।। শুন শুন শুন মাগো বলি তব ঠাই। তব ঘরে পুত্র কন্যা দেখিতে না পাই।। তোমার মঙ্গল লাগি আসিয়াছি হেথা। তব গর্ভে পুত্র হবে শুন সেই কথা।। তারক নামেতে মোর ভক্ত একজন। তোমাদের কোর্টে এসে দিবে দরশন।। তারে যদি ঘরে এনে করিবে যতন। তার বরে তব গর্ভে হইবে নন্দন।। তাই বলি ওগো বাবা চরণে জানাই। তোমার বরেতে যেন পুত্র ধন পাই।। কান্না দেখে তারকের দয়া উপজিল। মস্তকেতে হস্ত দিয়ে কহিতে লাগিল।। শুন শুন শুন মাগো বলি তব ঠাই। তব গর্ভে ছেলে হবে কোন চিন্তা নাই।। এই বাক্য যখনেতে তারক বলিল। কেন্দে কেন্দে সেই নারী চরণে পড়িল।। নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়। জজ বাবু পড়িলেন তারকের পায়।। এই ভাবে ভক্তি স্তুতি করিতে করিতে। তারক বুঝায় শেষে বিশুদ্ধ ভাবেতে।। ভাবাবেশে সেই নারী রন্ধন করিয়া। ভোজন করায় শেষে কান্দিয়া কান্দিয়া।। প্রাণভরি সে তারক ভোজন করিল। বলে কয়ে সেই দিন গৃহেতে চলিল।। পরদিন জজ বাবু কোর্টেতে উদয়। নজর পড়িল গিয়ে রায়ের খাতায়।। ভাল করে লক্ষ করে দেখিবারে পায়। নিজের হাতের লেখা খাতার পাতায়।। খালাস পেয়েছে মতি দেখিতে পাইল। ছাপাই স্বাক্ষীর পরে খালাস হইল।। তাই দেখে জজ বাবু ভাবিল হৃদয়। নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।। মতিকে বাহির করি বুকেতে ধরিয়া। মিনতী করিল কত কান্দিয়া কান্দিয়া।। মতিকে বিদায় করি গৃহেতে চলিল। অধম বিনোদ বলে হরি হরি বল।। জজের পুত্র লাভ তারকের কৃপালাভ ফাঁসি থেকে মুক্তি পেয়ে করিল গমন। পথে যেতে সেই মতি ভাবে মনে মন।। জজের কাছেতে শুনে তারকের কথা। হৃদয় জাগিল তার বিরহের ব্যাথা।। তারক তারক বলে ছাড়িতেছে হাই। দয়ার সাগর মোর তারক গোঁসাই।। ফাঁসি থেকে মুক্তি পাই যাহার কৃপায়। এহেন দরদী আমি পাইব কোথায়।। মনে ভাবে আর আমি গৃহেতে না যাব। জনমের মত আমি দাস হয়ে রব।। ভাবে গদ গদ চিত্ত চলেছেন পথে। জলে ভরা আখি দু’টি লাগিল হাটিতে।। তারকের ছবি খানি হৃদয় ধরিয়া। নয়নের জলে বক্ষ যেতেছে ভাসিয়া।। ভাবা বেশে সেই জয়পুর গিয়া। তারকের পদে পড়ে কহিছে কান্দিয়া। শুন শুন শুন বাবা চরণে জানাই। গৃহে যেতে কহিও না ধর্মের দোহাই।। এ জীবনে আমি আর গৃহে নাহি যাব। চরণের দাস হয়ে তব গৃহে রব।। জীবন পেয়েছি আমি তোমার স্মরণে। কৃপা করে ওগো বাবা রাখিও চরণে।। এ জীবনে ওগো বাবা অন্য আশা নাই। পদে যেন থাকে ভক্তি এই ভিক্ষা চাই।। এই ভাবে সেই মতি কান্দিতে লাগিল। তাই দেখে তারকের দয়া উপজিল।। তারক কহিছে মতি শুন বাছাধন। ভক্তি পথে থাকে যেন সদা তব মন।। মুখে কর হরি নাম হাতে কর কাম। মানব জীবনে হয় শেষ পরিনাম।। মম গৃহে থেকে তুমি সত্য কথা কও। মুখে হরি হরি বলে জীবন কাটাও।। তাই শুনে সেই মতি তথায় রহিল। ওদেকে জজের ঘরে পুত্র জনমিল।। পুত্র কোলে করে সেই জজের রমনী। তারক তারক বলে কান্দে সেই ধনী।। উদ্দেশ্য তারক পদে প্রণাম জানায়। আনন্দেতে আত্মহারা জজের হৃদয়।। জজ বাবু মনে মনে তারকে স্মরিয়া। তারকের গুণগান বেড়ায় গাহিয়া।। এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল। দিনে দিনে সেই পুত্র বাড়িতে লাগিল।। ছয় মাস পরে সেই জজের রমনী। জজের পাশেতে বসে কহিল তখনি।। তারক চাঁদের বরে পেয়েছি তনয়। জননী হয়েছি আমি তাহার কৃপায়।। পুত্রধন লয়ে যাই তারকের বাড়ী। আশীর্বাদ দিবে তিনি বলে হরি হরি।। তাই শুনে জজ বাবু কহিল তখন। কল্য প্রাতে চল মোরা করিব গমন।। তাই শুনে সেই নারী আনন্দে মাতিয়া। সারা নিশিগত হয় তারকে ভাবিয়া।। পরদিন ভোর বেলা করিল গমন। পুত্র কোলে করে চলে আনন্দিত মন।। তারকের গুণগান করিতে করিতে। আনন্দেতে আত্মহারা লাগিল হাটিতে।। সন্ধ্যার অগ্রেতে গিয়ে হইল উদয়। সেই মতি বসে আছে দেখিবার পায়।। ফাঁসি থেকে মুক্তি পেয়ে যেই দিন এল। সেই দিন হতে মতি দাঁড়ি না কাটিল।। তারক চাঁদের প্রায় দেখিবার পায়। বসে বসে সেই মতি হরিগুণ গায়।। মতির কোলেতে সেই পুত্র ধন দিয়ে। দুই জনে কান্দিতেছে চরণে পড়িয়ে।। তাই দেখে সেই মতি ভাবিল হৃদয়। জজ বাবু চেনে নাই করি কি উপায়।। কেন্দে কেন্দে সেই মতি কহিল তখন। শুন শুন জজ বাবু আমার বচন।। আমি তব সেই মতি তোমাকে জানাই। ভেবেছ কি আমি সেই তারক গোঁসাই।। তাই বলে জজ বাবু মতিকে কহিল। ফাঁসি থেকে মুক্তি পেলে আমি জানি ভাল।। তুমি যদি নাহি যেতে আমার কোর্টেতে। আমাদের ঘরে পুত্র হইত কি মতে।। আগে তুমি মম পুত্রে কর কৃপা দান। আগে আশীর্বাদ কর ওহে মতিমান।। তাই শুনে সেই মতি কান্দিতে লাগিল। নয়নের জলে বক্ষ প্লাবিত হইল।। সেই ছেলে বুকে ধরে তারকে স্মরিয়া। আশীর্বাদ দেয় তারে কান্দিয়া কান্দিয়া।। হেনকালে সে তারক আসিল তথায়। জজ বাবু পড়িলেন তারকের পায়।। পুত্র কোলে করে সেই জজের রমণী। নয়নের জলে ভেসে কহিতেছে বাণী।। ওগো বাবা বলি তোমা আমার বচন। তোমার কৃপায় পাই এই পুত্র ধন।। কৃপাকর ওগো বাবা চরণে জানাই। পদে যেন থাকে ভক্তি এই ভিক্ষা চাই।। এত বলি পুত্র দিয়ে তারকের কোলে। চরণে পড়িয়া সতী ভাসে আখি জলে।। তাই দেখি তারকের ঝরে আখি জল। আধ আধ ভাসা দিয়ে বলে হরিবল।। হরিচাঁদ ছবিখানি হৃদয়ে ধরিয়া। শিশু মুখে চুমু দেয় আনন্দ পাইয়া।। দয়ার সাগর মোর তারক সুজন। আশীর্বাদ দিয়ে সবে দেয় প্রেমধন।। অধম বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে। তারকের ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।। তাই বলি ভাই সব বেলা বেশী নাই। হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরিবল ভাই।। মধুসূধন সরকারের উপাখ্যান হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ভাবিয়া হৃদয়। লিখিতে কলম ধরি করিনু আশায়।। তারক চাঁদের কথা বরিব বর্ণন। আশ্চর্য্য ঘটনা এক শুন দিয়া মন।। কবিগান করে তিনি দেশ দেশান্তর। হরিচাঁদ গুণগান করেন প্রচার।। একদিন চলিলেন রাঙ্গা মাটি গায়। দল বল সহ সেথা হলেন উদয়।। বিপক্ষের সরকার ছিল এক জন। কুটিশ্বরী বাড়ী নাম শ্রীমধুসূদন।। জাতিতে পরামানিক ছিল পরিচয়। তারকের সংগে গান করে মহাশয়।। মনে মনে ভাবিতেছে সে মধুসূদন। কাড়ারের সঙ্গে গান করিব এখন।। ও জাতির ভাত কভু খাওয়া না যায়। পরশ করিলে হয় পাপ সু-নিশ্চয়।। ইতি উতি কত কিছু ভাবিতে লাগিল। জাতি হিংসা অন্তরে জাগিয়া উঠিল।। কবির খোলায় বসে কত নিন্দা করে। বাহাদুরি নিতে চায় কবির আসরে।। তাহা শুনি সে তারক আসরেতে যায়। শাস্ত্রের মাধ্যমে তারে কত যে বুঝায়।। তাহাতেও তার মনে বিকার রহিল। বিধাতার বিধি যাহা কে খণ্ডাবে বল।। গান শেষে সব দল বিদায় হইল। যার যার বাড়ী সবে গমন করিল।। পর দিন গৃহে গিয়ে সে মধুসূদন। ইতি উতি কত কিছু ভাবে মনে মন।। পেট ব্যাথা দেখা দিল সেই দিন হতে। জুড়ায় না সেই ব্যাথা কোন ঔষুধেতে।। ডাক্তার কবিরাজ দেখাইল কত। দিন দিন সেই ব্যাথা বাড়ে অবিরত।। আজ মরে কাল মরে অস্থিচর্ম সার। মনে মনে ভাবে সদা আমি দুরাচার।। একদিন স্বপনেতে দেখিতে পাইল। হরিচাঁদ এসে তারে কহিতে লাগিল।। শুন ওরে বাছাধন বলি আজ তোরে। গুরু করে এস গিয়ে সেই তারকেরে।। তারকের নিন্দা করে হল তোর ভোগ। তারকের সনে গিয়ে কর যোগাযোগ।। আমার ভক্তের নিন্দা করে যেই জন। এই মত ভোগ তার হয় সর্বক্ষণ।। তারকের বাড়ী গিয়ে খাও তার ভাত। হেন কালে নিদ্রা ভঙ্গ হল অকস্মাৎ।। মনে মনে কত যে কি ভাবিতে লাগিল। নয়নের জলে বক্ষ প্লাবিত হইল।। একি আজি দেখিলাম ঘুমের ঘরেতে। অপূর্ব মুরতীখানি দেখিনু চোখেতে।। আজানু লম্বিত ভূজ চৌরাশি কপাল। স্বপনে দিলেন দেখা পরম দয়াল।। আমি অতি মূঢ়মতি না জানি সাধন। দয়াময় হরি আজ দিল দরশন।। ধন্য ধন্য শ্রী তারক হরিচাঁদ ভক্ত। হরিচাঁদ গুণনিধি তব অনুগত।। হরিচাঁদে বাঁধিয়াছ ভক্তি গুণ দিয়া। আমার জনম ধন্য তোমাকে নিন্দিয়া।। এই ভাবে নিশি জাগি কান্দিতে লাগিল। হেন কালে দিনমণি উদয় হইল।। প্রভাত হইল দেখি সে মধুসূদন। কারে কিছু না বলিয়া করিল গমন।। বাড়ী থেকে যাত্রা করে পদ্মডাঙ্গা এল। হেনকালে দীননাথ দেথিতে পাইল।। দীননাথ বলে ভাই এত ভোর বেলা। এই বেশে চলিয়াছ কোথায় একলা।। দীননাথের সঙ্গেতে ভালবাসা ছিল। সকল মনের কথা তাহাকে কহিল।। যাব আমি জয়পুর তারকের বাড়ী। যাত্রা করিয়াছি আমি বলে হরি হরি।। দীননাথ বলে ভাই আমিও যাইব। তারকেরে গুরু করি পদে লুটাইব।। বহুদিন এই কথা জাগে সর্বক্ষণ। যাব যাব মনে ভাবি হয়না কখন।। যখন পেয়েছি ভাই তব দরশন। আর না করিব দেরি করিব গমন।। এই ভাবে দুই জনে কথপোকথন। হেনকালে আসিলেন আর এক জন।। শ্রীহরি ভজন নাম পদ্মডাঙ্গা বাড়ী। শুনিয়া সকল কথা ফেলে অশ্রুবারি।। বলে আমি তোমাদের সঙ্গেতে যাইব। তারকের কাছে গিয়ে বাসনা পুরা’ব।। তিন জনে এক আত্মা নাহি ভিন্ন ভাব। বহু দিন হতে এই তিনের স্বভাব।। হরিবোলে তিন জনে করিল গমন। ভাবে গদ গদ চিত্ত ঝরে দু’নয়ন।। পথে যেতে কত কিছু ভাবিতে লাগিল। সন্ধ্যা বেলা জয়পুর উপনীত হল।। তারকের পদে পড়ে কান্দিতে লাগিল। তোমাকে নিন্দিয়া মোর হেন দশা হল।। তারক দেখিয়া বলে হে মধুসূদন। এহেন দীনতা তুমি হলে কি কারণ।। মধু কহে যে গোঁসাই শুন সমাচার। আচম্বিত পেট ব্যাথা হইল আমার।। ওষুধ খাইয়া কোন না হল উপায়। বেদনায় দিবারাত্রি করি হায় হায়।। একদিন স্বপনেতে হরিচাঁদ কয়। তারকে নিন্দিয়া তোর হেন দশা হয়।। আমার ভক্তের নিন্দা করে যেই জন। হেন দশা হয় তার শুন বাছাধন।। মুক্তি যদি পেতে চাও তার কাছে যাও। তারকেরে গুরু করি তার ভাত খাও।। তাই বলি ওহে গুরু করি প্রণিপাত। দয়া করে অধমেরে খেতে দাও ভাত।। তারক বলেছে আমি কিছুই না জানি। যার কাজ সেই করে হরি গুণমণি।। আমি মাত্র নিমিত্তের ভাগি শুধু হই। তার কৃপা পেয়ে আমি এ জগতে রই।। হরিচাঁদ লীলা খেলা কে বুঝিতে পারে। বলিতে বলিতে তারকের অশ্রু ঝরে।। মহাভাব উথলিল এমন সময়। তারকের পদে সবে গড়াগড়ি যায়।। তারক বলেছে সবে সুস্থ কর মন। ভাত রান্না করা আছে কর হে ভোজন।। হেন বাক্য শ্রীতারক যখন বলিল। মায়ের চরণে গিয়ে প্রসাদ মাগিল।। হাসি মুখে ঠাকুরাণী দিলেন প্রসাদ। কাচাঁ লঙ্কা পান্তা ভাত মধুর আস্বাদ।। ভাত খেয়ে কহিতেছে সে মধুসূদন। পেট ব্যাথা দুরে গেছে ধন্য এ জীবন।। ভালবেসে তিনজন রাত্রি কাটাইল। তারকেরে গুরু করি দেশেতে চলিল।। যাই বার কালে সবে কেন্দে কেন্দে কয়। তব শ্রীচরণ বিনে দাড়াব কোথায়।। এই দেহ মন প্রাণ সকল তোমার। যাহা ইচ্ছা তাহা কর তুমি গুরু সার।। তব ভাত খেয়ে গুরু করিয়াছি মোরা। ভাগ্যে যেন কিবা আছে মনে জাগে সাড়া।। তারক বলেছে ভাগ্য সু-প্রসন্ন হল। মতুয়া হয়েছ এবে হরি হরি বল।। তারকের পদধুলি মস্তকে করিয়া। তিন জনে আসিলেন দেশেতে চলিয়া।। অধম বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে। হরিচাঁদ ছবি খানি হৃদয়েতে বন্দে।। তাই বলি ভাই সব বেলা ডুবে গেল। হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি হরি বল।। গুরু শিষ্য অভেদ মধু আর দীননাথ শ্রীহরি ভজন। হরি বোলে হইল যবে এই তিন জন।। তারকেরে গুরু করি খেল তার ভাত। তিনজনে জয়পুর করে যাতায়াত।। তাই শুনে গ্রাম্য লোকে কহিতে লাগিল। কাড়ারের ভাত খেয়ে জাতি মান গেল।। গ্রামবাসী যত লোক বসি এক ঠাই। তিন জনে ডাকি আনি কহিল সবাই।। বে-জাতির ভাত কেন খেলে তিন জন। সামাজিক প্রথা কেন করিলে বর্জন।। মধু কহে জোড় হাতে সবার স্বাক্ষাতে। গুরু প্রসাদ খেলে ক্ষতি কি তাহাতে।। তিনজন গুরু করি খাইলাম অন্ন। ইহাতে কি হইয়াছি এতই জঘন্য।। জাতি হিংসা দলাদলি মোটেই কর না। জাতি হিংসা করে মোর এহেন যাতনা।। তাই শুনি গ্রাম্য লোক রুষিয়া উঠিল। যাহা আসে তাহা মুখে কহিতে লাগিল।। একজনে বলে ভাই সবাকে জানাই। ইহাদের সঙ্গে কোন মেলামেশা নাই।। এক ঘরে করে রেখ এই তিন জনে। সামাজিকতা করিব না ইহাদের সনে।। তাহা শুনি গ্রাম্য লোক করিলেন তাই। তিন জন বাদ প’ল জানিল সবাই।। তাই শুনে তিন জন জয়পুর যায়। তারকের কাছে গিয়ে এসব জানায়।। তারক বলেছে বাছা মন ঠিক চাই। হরিচাঁদের কৃপায় কোন চিন্তা নাই।। গুরুর আদেশ বাণী শুনিয়া কর্ণেতে। তুষ্ট হয়ে তিন জন আসিল বাটিতে।। এই ভাবে কত দিন গত হয়ে যায়। সমাজের মধ্যে তারা স্থান নাহি পায়।। দৈব যোগে একদিন ঝড় বযে যায়। প্রলয় ঝড়েতে সব গ্রাম উজাড়য়।। মধুসুদনের এক বড় এক ঘর ছিল। সেই ঝড়ে ঘরখানি মাটিতে পড়িল। কি করিবে কোথা যাব ভাবিয়া না পায়। ঘর উঠাইবে বলে গ্রামেতে জানায়।। গ্রামের লোক বলে মোরা পারিব না। ঘর উঠাইয়া লহ সেই তিন জনা।। গালাগালি দিয়ে সবে এই কথা কয়। দেখি তোর কোন বাবা ঘর তুলে দেয়।। এ কথা শুনিয়া মধু পদ্মডাঙ্গা যায়। দীননাথ আর হরি ভজনে জানায়।। ঘর পরে গেছে ভাই কি হবে উপায়। গ্রামবাসী সব লোকে বলেছে আমায়।। গালাগালি দিয়ে বলে মোরা পারিব না। ঘর উঠাইয়া লহ সেই তিন জনা।। তাহা শুনে দীননাথ কহিতে লাগিল। তিনজনে ঘর ধরে উঠাইব চল।। এই বলি তিনজন করিল গমন। ঘরের নিকটে গিয়ে দিল দরশন।। ঘুটিপুতি আড়াগুলি সকল বাঁধিল। তারক তারক বলে কান্দিতে লাগিল।। যেই চাল উঠাইতে লাগে বিশজন। তারকে স্মরণ করি ধরিল তখন।। তিন জনে চাল ধরি উঠাইয়া দিল। কিছুদূর উঠে চাল নামিতে লাগিল।। তিন জনে চাল ধরি ঠেলিছে উপরে। তবু সেই চাল খানি নিচে সরে পড়ে।। ওদিকেতে জয়পুর তার গোঁসাই। ছটফট করিতেছে মন সুস্থ নাই।। চারিদিকে বসে আছে দোঁহারের গণ। তার মধ্যে বসে আছে সূর্য্য নারায়ণ।। অমনি তারক চন্দ্র উঠে দাড়াইল। উপরের চাল ধরি ঠেলিতে লাগিল।। তাহা দেখি কহিতেছে সূর্য্য নারায়ণ। ঘর ধরি ঠেল তুমি কিসের কারণ।। তারক কহিছে আমি সহিতে না পারি। আমাকে ডেকেছে মধু থেকে ঝুটিশ্বরী।। প্রচন্ড ঝড়েতে তার ঘর পড়ে গেছে। ঘর উঠাইবে বলে আমাকে ডেকেছে।। মধু আর দীননাথ শ্রীহরি ভজন। স্বকাতরে ডাকিতেছে করিয়া স্মরণ।। মনপ্রাণ সপে দিয়ে ডাকিতেছে তারা। সেই জন্য প্রাণে মোর জাগিতেছে সাড়া।। এত বলি শ্রীতারক মৌন হয়ে রয়। মহাভাব উথলিয়া বক্ষ ভেসে যায়।। তাই দেখে মনে ভাবে সূর্য্য নারায়ণ। ঝুটশ্বরী যাবে বলে করিলেন মন।। পর দিন চলিলেন কাঙ্গালীকে নিয়ে। দুইজনে পথে চরে শ্রীহরি স্মরিয়ে।। পথে যেতে কত কিছু ভাবিতে লাগিল। সন্ধ্যা বেলা ঝুটিশ্বরী উপনীত হল।। দু’জনারে দেখে মধু আনন্দ হৃদয়। চরণ ধোয়ায়ে শেষে আসনে বসায়।। স্বভক্তি প্রণাম করি জিজ্ঞাসে তখন। বল ভাই কোথা হতে তব আগমন।। সূর্য্য নারায়ণ বলে বলি তব ঠাই। জয়পুর হতে মোরা এসেছিরে ভাই।। দু’টি কথা জিজ্ঞাসিব বলহে এখন। ঝড় হয়ে ঘর প’ল কবে এ ঘটন।। সেই ঘর কবে তুমি উঠাইলে ভাই। কহ কহ কহ ভাই পরাণ জুড়াই।। মধু কহে গত কাল ঘর তুলিলাম। তিন জনে ঘর তুলি ল’য়ে গুরু নাম।। তারকের নাম ল’য়ে তুলি এই ঘর। তারক তারক বলে কান্দিছে অন্তর।। সেই হতে মন পাখি জয়পুর গেছে। জয়পুর যাব বলে মনে জাগিতেছে।। তাই শুনে কেন্দে বলে সূর্য্যনারায়ণ। মধুকে ধরিয়া শেষে করে আলিঙ্গন।। শুন শুন শুন মধু তোমাকে জানাই। বাড়ী বসে ঘর ঠেলে তারক গোঁসাই।। কেন্দুয়ার বিল পাশে যখনেতে গেল। দযার সাগর মোর কহিতে লাগিল।। শুন শুন ওগো সর্প বলিয়ে তোমায়। বিল মধ্যে চলে যাও নাহি কোন ভয়।। এই বিলে আছে কত বড় বড় ধাপ। সেই খানে আছে তব স্বজাতির সাপ।। ভয় নাই চলে যাও সুখে কর বাস। সাপুড়িয়া ধরিবে না দিলাম আশ্বাস।। এই বাক্য শ্রী তারক যখন বলিল। সাপের চোখের জল দিগুণ বাড়িল।। মনে মনে ভাবে সর্প আর কোথা যাব। হেন সঙ্গ আমি আর কোথা গিয়া পাব।। আমার জীবন ধন্য হেন সঙ্গ পেয়ে। তাই ভেবে মুখ পানে রহিলেন চেয়ে।। তাই দেখে শ্রী তারক ভাবে মনে মন। যাদবেরে ডেকে ডেকে কহিল তখন।। দুই জনে সাপ ধরে ছাড়াইয়া দাও। ভয় নাই ছাড়াইয়া জঙ্গলে ফেলাও।। তাই শুন দুই জন সর্পকে ধরিল। ধরে নিয়ে সেই সাপ জঙ্গলে ফেলিল।। জঙ্গলে পড়িয়া সর্প ভাবে মনে মন। তীর বেগে ছুটে গিয়ে ধরিল চরণ।। তারকের দু’টি পদ জড়াযে ধরিল। ফণা বিস্তারিয়া শেষে কান্দিতে লাগিল।। তাই দেখে সে যাদব কহিল তখন। শুন বাবা বলি তোমা আমার বচন।। ভাষাহীন সর্প জাতি কান্দিয়া বুঝায়। তোমার চরণে সাপ কি যেন কি চায়।। তাই শুনে তারকের দয়া উপজিল। মস্তকেতে হস্ত দিয়া কহিতে লাগিল।। এরপর জন্মে তুমি মনুষ্য হইবে। হরি ভক্ত হয়ে সদা হরি গুণ গাবে।। এই বাক্য যখনেতে তারক বলিল। চরণ ছাড়িয়া সর্প প্রণাম করিল।। প্রণাম করিয়া সর্প জঙ্গলেতে যায়। বিনোদ কহিছে হরি বল রসনায়।। হেনকালে উপনীত সেই তিনজন। অগ্র ভাগে চলিতেছে তারক সুজন।। বৃক্ষতলে যখনেতে উপনীত হল। বৃক্ষমূলে থেকে সর্প দেখিতে পাইল।। সর্প রাজ মনে ভাবে এইত সময়। লাফ দিয়ে পড়িলেন তারকের গায়।। বুকে পিঠে জড়াইয়া গলেতে জড়ায়। ফণা বিস্তারিয়া শেষে মুখ পানে চায়।। তারক ভাবিছে মনে একি হল দায়। সর্পের চোখের জল দেখিবার পায়।। তাই দেখে তারকের দয়া উপজিল। সর্পের মাথায় হাত বুলাতে লাগিল।। বলে শুন ওগো সর্প বলিয়ে তোমায়। তোমাকে অভয় দিনু নাহি কোন ভয়।। এদিকেতে সাপুড়িয়া তারা দুইজন। সর্পটিকে ধরে নিতে আসিল তখন।। তাই দেখে শ্রীতারক করিতেছে মানা। কোন মতে এই সর্প দিতে পারব না।। তাই শুনি সে যাদব গর্জিয়া উঠিল। সাপুড়িয়াগণে ধরে গলা ধক্কা দিল।। ধাক্কা মেরে তাহাদের দেয় তাড়াইয়া। মার খেয়ে দুই জন গেলেন চলিয়া।। তারপর চেয়ে দেখে যাদব দুজন। সাপের আশ্চর্য্য লীলা করি দরশন।। অমনি সে দুই জন চরণে পড়িল। চরণ ধরিয়া শেষে কান্দিতে লাগিল।। কেন্দে বলে ওগো বাবা ঠেলিও না পায়। মানুষ হইয়া মোরা চিনি না তোমায়।। ভাষাহীন সর্প আজি তোমাকে চিনিল। তোমার পরশ পেয়ে প্রেমেতে ভাসিল।। এই ভাবে দুই জন করিছে ক্রন্দন। তাহাদের ধরে তোলে তারক সুজন।। তার পর কয় জন করিল গমন। প্রেমে গদ গদ চিত্ত ঝরে দু’নয়ন।। তারকের গলদেশে সাপ ঝুলিতেছে। সাপের জনম ধন্য আনন্দে ভেসেছে।। তারক জিজ্ঞাসা করে যাদবের ঠাই। তোমারা কেমন আছ বল শুনি ভাই।। যাদব বলেছে গুরু তোমার কৃপায়। সকলে কুশলে আছে আনন্দ হৃদয়।। তারক বলেছে শুন আমার বচন। আমার সঙ্গেতে চল তোমারা দু’জন।। কাতলী গ্রামেতে যাব করিয়াছি মন। সেই গ্রামে বাস করে ভক্ত নিবারণ।। হরিচাঁদ গুরুচাঁদে সদা তার মতি। তথায় যাইতে হবে চল শীঘ্রগতি।। যাদব মল্লিক বলে শুন দিয়া মন। এই খানে করিয়াছি সেবা আয়োজন।। তারক বলেছে তুমি শীঘ্র দাও খেতে। হেথা হতে বহু পথ হইবে যাইতে।। ব্যাস্ত হয়ে সবে মিলে করিয়া ভোজন। তথা হতে তিন জন করিল গমন।। হরিচাঁদ গুণকথা বলিতে বলিতে। ভাবে গদ গদ চিত্ত লাগিল হাটিতে।। খুলনা জেলা আছে মোল্লাহাট থানা। গাওনা সে বড় গ্রাম সকলের জানা।। তাহার উত্তর পাশে এক ভিটা আছে। সাপুড়িয়া এসে তথা সাপ ধরিতেছে।। বহু সাপ ধরে তারা হাড়িতে পুরিল। বড় এক সাপ শেষে ছুটিয়া পালাল।। রাস্তার পাশে এক বড় গাছ ছিল। সে গাছের মূলে গিয়ে ঝুলিতে লাগিল।। সাপুড়িয়া দুই জনে গাছে উঠিয়াছে। সাপ ধরিবারে তারা তাড়া করিয়াছে।। সর্প রাজ ভাবিতেছে উপায় কি করি। মনে মনে ডাকিতেছে তোমায় শ্রী হরি।। এ বিপদে আজি মোরে রক্ষা কর তুমি। ভাষাহীন অপরাধী সর্প জাতি আমি।। কিবা কর্ম ফলে আমি হইয়াছি সাপ। মনে হয় পূর্ব জন্মে করিয়াছি পাপ।। বিপদে পড়িয়া ডাকি ওগো দয়াময়। রক্ষা কর আমি করে আসিয়া হেথায়।। তাহা শুনি সেই মধু ধুলাতে লুটায়। কাঙ্গালী পড়িল গিয়ে সে মধুর পায়।। মধুর চোখের জলে ধরা ভেসে যায়। পরিবার সহ এসে পড়িল ধরায়।। এই ভাবে সবে মিলে কান্দিতে লাগিল। বহুক্ষণ পরে শেষে প্রেম সম্বরিল।। সূর্য্য নারায়ণ আর কাঙ্গালীকে লয়ে। ভোজন করায় শেষে কান্দিয়ে কান্দিয়ে।। সেই হতে সেই মধু প্রেমিক হইল। হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি হরি বল।। কান্দিয়া বিনোদ বলে বেলা বেশি নাই। তারকর প্রীতে সবে হরি বল ভাই।। তারক চাঁদ ও সর্প কথা হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ভাবিয়া অন্তরে। আশ্চর্য্য ঘটনা এক জানাব সবারে।। জয়পুর বাস করে কবি রসরাজ। হরিভক্ত বলে যানে ভক্তের সমাজ।। একদিন শ্রী তারক পদুমা চলিল। যাদবের বাড়ী গিয়ে উপনীত হল।। পদুমায় হরিভক্ত ছিল যত জন। একে একে সবে এসে দিল দরশন।। সকলে তারক পদে প্রণাম করিল। যাদব মল্লিক এসে চরণে পড়িল।। ভক্তি গদ গদ চিত্ত ঝরে দু’নয়ন। যাদবের নারী এসে ধোয়াল চরণ।। বসিতে আসন দিল উত্তরের ঘরে। ধূপ ধুনা দিয়ে শেষে গাড় ভক্তি করে।। উলুধ্বনি হরিধ্বনি করে সবে মিলে। হরিভক্ত সঙ্গ পেয়ে ভাসে আখি জলে।। ভক্তিভরে তারকের সেবা করাইল। হরিকথা রসরঙ্গে তথায় বঞ্চিল।। লোহারগাতী বাড়ী যাদব চন্দ্র ঢালী। তারকের প্রিয় শিষ্য জানিত সকলি।। সংবাদ পাইয়া তিনি পদুমা আসিল। তারকের পদে এসে প্রণাম করিল।। তারকের কাতলী গমন ও আশ্চার্য্য লীলা সর্পকে করিয়া মুক্তি চলে তিন জন। ধীরে ধীরে করিলেন কাতলী গমন।। ভাবে গদ গদ চিত্ত চলেছেন পথে। উপনীত হল গিয়া কাতলী গ্রামেতে।। দেখিয়া সে নিবারণ চরণে পড়িল। চরণ ধরিয়া শেষে কান্দিতে লাগিল।। পরিবার সহ এসে প্রণমিল পায়। চরণ ধোয়ায়ে শেষে আসনে বসায়।। নিবারণ বলে গুরু তব আগমনে। এ জীবন ধন্য হল তোমা দরশনে।। নিবারণের চোখেতে বারি ধারা বয়। তাই দেখে কয় ভাই চরণে লুটায়।। জেষ্ঠ্য শ্রী মহেশ চন্দ্র মেঝ নিবারণ। তৃতীয় সে ধনঞ্জয় বিশ্বাস সুজন।। সবার কনিষ্ঠ হয় নামেতে পেয়ারী। তারকেরে ভালবেসে বলে হরি হরি।। তারকেরে ভক্তি করি সেবা করাইল। হরিকথা রসরঙ্গে তথায় বঞ্চিল।। পরদিন ভোর বেলা করিয়া ভোজন। এসে শেষে চারিজন করিল গমন।। নিবারণ সঙ্গে চলে যাদব দু’জন। খাড়িয়া গ্রামেতে গিয়ে দিল দরশন।। খাড়িয়ায় নিবারণ তাফালী নামেতে। হরিবাসর করিল তাহার বাটিতে।। তারকের আগমন শুনিয়া সকলে। আসিলেন কত ভক্ত হরি হরি বলে।। কাছে কাছে হরিভক্ত যত জন ছিল। তারকের কথা শুনি সকলে আসিল।। মাটিয়ার গাতী গ্রামে সাধু মৃতুঞ্জয়। তারকের প্রিয় শিষ্য সরল হৃদয়।। তিনি আসিলেন শুনে তারকের কথা। তারকের পদে এসে নোয়াইল মাথা।। কেন্দে বলে ওগো বাবা চরণে জানাই। মোর মত অভাজন এ জগতে নাই।। তব চরণে বাবা করি নিবেদন। মহোৎসব করিবারে হইয়াছে মন।। তুমি বাবা দিন ধার্য্য করিয়া যে দিবে। ভক্তগণ সঙ্গে করি উৎসব করিবে।। তাই শুনে শ্রী তারক কহিল তখন। ভাল কাজ করিবার হয় যদি মন।। সাত দিন পরে যেই বুধবার হবে। সেই দিন সাধু সেবা করিতে হইবে।। তাই শুনি মৃত্যুঞ্জয় আনন্দ পাইল। তারকের পদে পরি প্রণাম করিল।। তাই শুনে ভক্ত গনে হরিধ্বনি দেয়। কীর্তনে মাতিল সবে আনন্দ হৃদয়।। হরিনামে মাতোয়ারা হল ভক্তগণ। সারা নিশি হল তথা নাম সংকীর্তন।। নিবারণ পড়িলেন তারকের পায়। পরিবার সহ এসে গড়াগড়ি যায়।। কেহ কেহ কান্দিতেছে হরি হরি বলি। কেহ কেহ নচিতেছে দুই বাহু তুলি।। বহু পরে প্রেম নিধি হল শেষে ক্ষান্ত। হরি হরি বলে সবে হইলেন শান্ত।। তারপর সবে মিলে পান্থা সেবা করি। এক ঠাই বসিলেন বলে হরি হরি।। কত জনে দরবার করিল আসিয়া। তারকরে পদে পড়ে কহিছে কান্দিয়া।। আমাদের ঘরে গিয়ে পদধুলী দাও। অধমের মনবাঞ্ছা তুমি যে পুরাও।। এই ভাবে কত জনে কত কি কহিল। সবাকার ঘরে ঘর ঘুরিতে লাগিল।। এই ভাবে পাঁচদিন গত হয়ে গেল। কাতলী হইতে এক সংবাদ আসিল।। নিবারণে বাড়ী যেতে সংবাদ পাঠায়। নিবারণ জানাইল তারকের পায়।। ধান কাটা বাঁধিয়াছে আমি বাড়ী যাই। পদে যেন থাকে ভক্তি এই ভিক্ষা চাই।। তারক বলেছে গৃহে চলে যাও তুমি। মাটিয়ায় গাতী গ্রামে চলে যাব আমি।। সেই খানে মৃত্যুঞ্জয় সাধু সেবা দিবে। পার যদি তুমি বাছা সেখানে আসিবে।। নিবারণ চলে গেল দুঃখ করি মনে। সংসারের কর্ম করে গুরু চিন্তা প্রাণে।। তারপর শ্রী তারক করিল গমন। মাটিয়ার গাতী গ্রামে পৌছাল তখন।। দুই দিন পরে সেথা সাধু সেবা হবে। দুই তিন দিন সেথা তারক থাকিবে।। মৃত্যুঞ্জয় করিতেছে তার আয়োজন। আশে পাশে যত গ্রাম হল নিমন্ত্রণ।। এই ভাবে দুই দিন গত হয়ে গেল।। বুধবার উৎসব আরম্ভ হইল।। ওদিকেতে নিবারণ গৃহেতে বসিয়া। বড় ভাই মহেশেরে কহিছে কান্দিয়া।। বুধবার যেতে হবে মাটিয়ার গাতী। সেখানে যাইতে মোরে দিবে অনুমতি।। মহেশ বলেছে ভাই তাহা না হইবে। ধান কাটা না হইলে কেমনেতে যাবে।। বারে বারে আমি ভাই করিতেছে মানা। কোন মতে সেইখানে যেতে পারিবে না।। তাই শুনে নিবারণ ভাবে মনে মেন। গুরুর আদেশ আমি পালিব কেমনে।। এদিকেতে বড় ভাই করিতেছে মানা। কেমনে যাইব সেথা করে আনাগোনা।। এক বিঘা জমি মাত্র ধান্য রহিয়াছে। কেমনে কাটিব ধান মনেতে ভেবেছে।। সন্ধ্যা বেলা মনে মেন ভাবিতে লাগিল। তারকের ছবিখানি হৃদয় জাগিল।। পূর্ণিমার রাত্রি পেয়ে ভাবিল তখন। কাস্তে হাতে নৌকা বেয়ে করিল গমন।। কারে কিছু না বলিয়া ধান্য ভূমে গেল। তারক তারক বলে কান্দিতে লাগিল।। জলে ভার আখি দু’টি কাস্তে নিয়ে হাতে। নৌকা পরে বসে ধান লাগিল কাটিতে।। রাত্রি বেলা ভোজনেতে সকলে বসিল। নিবারণে না দেখিয়া মহেশ কহিল।। নিবারণ কোথা গেল বল শুনি তাই। সকলে কহিল মোরা কেহ দেখি নাই।। ক্রোধভরে সে মহেশ কহিল তখন। মোর কথা নাহি শুনে সেই নিবারণ।। কয় দিন সাধু গিরি করিয়া আসিল। আজ বুঝি পালাইয়া উৎসবে গেল।। এই বার বাড়ি এলে শুন সবে ভাই। পৃথক করিয়া দিব মোর ইচ্ছা তাই।। এই ভাবে কত কথা মহেশ কহিল। তারপর সবে মিলে শয়ন করিল।। ভোর বেলা সে মহেশ জাগিয়া তখন। বাড়ীর প্রাঙ্গনে এসে করে নিরীক্ষণ।। তথা হতে সে জমিতে দেখিবারে পায়। নিবারণ কাটে ধান বসিয়া নৌকায়।। আর এক জন ধান কাটে সে নৌকায়। আধ আধ অন্ধকারে চেনা নাহি যায়।। তাই দেখে সে মহেশ আর নৌকা নিয়ে। ধীরে ধীরে চলিলেন তরী খানি বেয়ে।। কিছু দুর গিয়ে দেখে আশ্চর্য্য ঘটনা। নৌকা পরে ধান কাটে তারক রসনা।। শ্রী তারক নিবারণ কাটিতেছে ধান। তাই দেখে সে মহেশ ভাবে মনে মন।। কত কিছু মনে মনে ভাবিতে লাগিল। ধীরে ধীরে তরী খানি বাহিয়া চলিল।। নিকটেতে গিয়ে দেখে আর কেউ নাই। একা সেই নিবারণ ধান কাটে তাই।। সকল জমির ধান কাটা হয়ে গেছে। তাই দেখে সে মহেশ কান্দিয়া বলেছে।। শুন ভাই নিবারণ তোমাকে জানাই। মোর মত অভাজন এ জগতে নাই।। এত বলি নিবারণে বুকেতে ধরিয়া। জলে ভরা আখি দু’টি কহিছে কান্দিয়া।। তব নায় ধান কাটে তারক রসনা। তোমা আমি কোন দিন কাজে কহিব না।। চল ভাই গৃহে যাই বলিব কি আর। তারকের পদে গিয়ে মাগি পরিহার।। তাই শুনে নিবারণ চরণে পড়িল। মহেশের পদধরি কান্দিতে লাগিল।। তার পর দুই ভাই কান্দিয়া কান্দিয়া। নৌকা বেয়ে আসিলেন গৃহেতে চলিয়া।। গৃত হতে দুই ভাই করিল গমন। ভাবে গত গত চিত্ত ঝরে দু’নয়ন।। মাটিয়ায় গাতী চলে ভাই দুই জন। চক্ষু জলে বক্ষ ভাসে আনন্দিত মন।। মৃত্যুঞ্চয় ভবনেতে সংকীর্তন হয়। চারিদিকে হরিভক্ত হরিগুণ গায়।। তার মধ্যে বসে আছে তারক গোঁসাই। হেনকালে উপনীত হল দু’টি ভাই।। তারকের পদে পড়ে কান্দিতে লাগিল। তাই দেখে শ্রীতারক বলিয়া উঠিল।। শুন বলি নিবারণ বলি তব ঠাই। হাতে মোর ঠোষা প’ল চেয়ে দেখ তাই।। সারা নিশি ধান কেটে হাতে পল ঠোষা। কিবা দিয়ে বুঝাইব নাহি মোর ভাষা।। তাই দেখে সে মহেশ গড়াগড়ি যায়। তারকের পদ ধরি কেন্দে কেন্দে কয়।। ক্ষম বাবা অপরাধ অধম বলিয়া। আজ হতে নিবারণে দিলাম সপিয়া।। আজ হতে কয় ভাই সংসারে খাটিব। নিবারণে কোন দিন কাজে না বলিব।। তাই শুনে নিবারণ কেন্দে কেন্দে কয়। মহেশের পদে পড়ে গড়াগড়ি যায়।। তুমি মোর জেষ্ঠ্য ভাই পিতৃতুল্য হও। করিয়াছি অপরাধ ক্ষমা করে দাও।। তারপর তারকের পদধরি কয়। তোমার চরণ বিনে দাঁড়াব কোথায়।। তোমার চরণে বাবা এই ভিক্ষা চাই।। জনমে জনমে যেন ভুলিয়া না যাই।। সেই খানে হরিভক্ত যত জন ছিল। তারকের পদে পড়ে কান্দিতে লাগিল।। সবাকার নয়নেতে বারি ধারা বয়। প্রেমের তরঙ্গে সবে ভাসিয়া বেড়ায়।। তাই দেখে মনে মনে ভাবে মৃত্যুঞ্জয়। পরিবারসহ এসে পড়িল ধারায়।। প্রেমের তরঙ্গ ওঠে আকাশ ভেদিয়া।। তার মধ্যে ভক্তগণে বেড়ায় ভাসিয়া।। নারী কি পুরুষ তার নাহি ভেদ জ্ঞান। প্রেমের পাথারে সবে ভাসিয়া বেড়ান।। হরি হরি হরি বলে যত ভক্তগণ। লেখা দিয়া কি বুঝাব আমি অভাজন।। বহু পরে প্রেমনিধি হইলেন ক্ষান্ত। হরি হরি হরি বলে সবে হল শান্ত।। অধম বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে। তারকের ছাবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।। তাই বলি ওরে মন বেলা বেশি নাই। হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।। উভয় সংকট লোহারগাতী বাড়ী যাদব চন্দ্র ঢালী। তারকের প্রিয় ভক্ত জানিত সকলি।। গুরুপদে ভক্তি করি হরিগুণ গায়। মাঝে মাঝে সে যাদব ওড়াকন্দি যায়।। গুরুচাঁদ চরণেতে প্রণাম করিয়া। ছল ছল আখি দু’টি কহিত কান্দিয়া।। ওগো বাবা গুরুচাঁদ চরণে জানাই। পদে যেন থাকে ভক্তি এই ভিক্ষা চাই।। তাই শুনে গুরুচাঁদ কহিত তখন। শুনরে যাদব তুমি আমার বচন।। আমার বাবার ভক্ত ভালবাসে যেই। প্রাণভরে সব কিছু আমি তারে দেই।। যাও বাছা গৃহে চলে কোন চিন্তা নাই। এই ভাবে ভক্তি পথে মন খাটি চাই।। তাই শুনে সে যাদব গৃহেতে আসিত। হাতে কাম মুখে নাম সংসার করিত।। একদিন সে যাদব ভাবে মনে মন। তারকেরে গৃহে এনে করাব ভোজন।। বিলে আছে কই মাছ আনিব ধরিয়া। গুরু সেবা করাইব সেই মাছ দিয়া।। তাই ভেবে সে যাদব প্রভাতে জাগিয়া। বিল মধ্যে চলিলেন পোলা হাতে নিয়া।। পোলা দিয়া কই মাছ ধরিতে লাগিল। বড় বড় কই মাছ অনেক ধরিল।। তিন কুড়ি কই মাছ গণনায় হল। তাই নিয়ে সে যাদব গৃহেতে আসিল।। তাহার নারীকে ডেকে কহিল তখন। ভাল ভাবে এই মাছ কর হে যতন।। বড় বড় কই মাছ বাছিয়া বাছিয়া। অন্য পাত্রে রাখ তুমি যতন করিয়া।। গুরুসেবা করাইব মনেতে ভেবেছি। তাই ভেবে এই মাছ ধরিয়া এনেছি।। যেই দিন মম গৃহে আসিবে গোঁসাই। এই মাছ দিয়া সেবা করাইব তাই।। তাই শুনে তার নারী তাহাই করিল। প্রধান প্রধান কই বারটি হইল।। অন্য এক হাড়ী মধ্যে তাতে জল দিয়া। সাবধানে রাখিলেন যতন করিয়া।। মনে মনে সে যাদব তারকে ভাবিয়া। আশা পথ পানে থাকে সতত ভাবিয়া।। কবে মোর মনবাঞ্ছা হইবে পূরণ। এই মাছ কবে এসে করিবে ভোজন।। এই ভাবে পাঁচ দিন গত হয়ে গেল। যাদবের নারী সেই আরোপে দেখিল।। পদুমায় আসিয়াছে তারক গোঁসাই। তথা হতে আসিতেছে দেখিলেন তাই।। তাই দেখে সেই নারী ভাবে মনে মন। আমাদের মনবাঞ্ছা হইবে পূরণ।। ব্যস্ত হয়ে করিতেছে পাক আয়োজন। সেই মাছ কুটিতেছে আনন্দিত মন।। হেনকালে যে যাদব কোথা হতে এল। সেই মাছ কুটিতেছে দেখিতে পাইল।। ক্রোধভরে গালাগালি করিয়া কহিল। গোঁসাইকে খাওয়াইব মনে আশা ছিল।। নিজে খাবি বলে তুই এ মাছ কাটিলি। আমার মনের আশা পুরাতে না দিলি।। এত বলি সে যাদব জষ্টি নিয়ে হাতে। প্রহার করেছে তার নারীর পৃষ্ঠেতে।। প্রহার করি কত গালাগালি দিয়ে। স্নান করিতেছে গিয়ে নদীতে নামিয়ে।। মা’র খেয়ে সে নারী কিছু না ভাবিল। কেন্দে কেন্দে সে নারী রন্ধন করিল।। কাঙ্গালীকে সঙ্গে করি তারক গোঁসাই। হেনকালে উপনীত দেখিলেন তাই।। তাই দেখে সে নারী চরণে পড়িল। চরণ ধরিয়া শেষে কান্দিতে লাগিল।। কেন্দে বলে ওগো বাবা বলি তব ঠাই। মোর মত অভাগিনী এ জগতে নাই।। করিয়াছি অপরাধ ক্ষমা কর মোরে। চরণ ধরিয়া বাবা বলি যে তোমারে।। তাই দেখে তারকের চোখে আসে জল। আধ আধ ভাষা দিয়া বলে হরি বল।। তারক বলেছে মাগো কান্দ কি কারণ। বড় খুধা লাগিয়াছে করিব ভোজন।। তাহা শুনে সেই নারী চরণ ধোয়ায়ে। বসিতে দিলেন সেথা আসন পাতিয়ে।। স্নান করি সে যাদব গৃহ পানে ধায়। দুর থেকে তারকেরে দেখিবারে পায়।। তার নারী তারকের পদে পড়ে কান্দে। তাই দেখে সে যাদব পড়িল বিপদে।। কি যেন ভাবিয়া শেষে পালাইয়া গেল। অন্য বাড়ী গিয়ে এক ঘরে লুকাইল।। তারকের আজ্ঞা পেয়ে সে নারী তখন। ছল ছল আখি দু’টি করিল রন্ধন।। রন্ধন করিয়া সতী করি আয়োজন। তারকের পদে গিয়ে কহিল তখন।। সেবা করিবারে বাবা করিয়াছি ঠাই। তোমাকে করাতে সেবা কোন ভক্তি নাই।। তাই শুনি শ্রীতারক কহিল তখন। কাঙ্গালীকে ডেকে বলে মধুর বচন।। শুন শুন ও কাঙ্গালী বলি যে তোমায়। যাদবেরে ডেকে আন গেল সে কোথায়।। তাই শুনে সে কাঙ্গালী করিল গমন। প্রতি ঘরে ঘরে গিয়ে করে অন্বেষণ।। যে ঘরেতে সে যাদব লুকাইয়া ছিল। তথা হতে যাদবেরে খুঁজিয়া আনিল।। অপরাধী মনে ভাবি যাদব তখন। ছল ছল আখি দু’টি ঝরে দুনয়ন।। তারকের নিকটেতে যখন আসিল। অমনি তারক চন্দ্র উঠিয়া দাঁড়াইল।। পৃষ্ঠদেশ দেখাইয়া বলিল তখন। মম পৃষ্ঠে চেয়ে দেখ ওরে বাছাধন।। মা’কে তুমি করিয়াছ দারুণ প্রহার। হরিচাঁদ রাখিয়াছে মম পৃষ্ঠ ‘পর।। তাই দেখে সে যাদব চরণে পড়িল। চরণ ধরিয়া শেষে কান্দিতে লাগিল।। কেন্দে বলে ওগো বাবা চরণে জানাই। এই জন্যে আমি কোন বেদনা না পাই।। হেন বাক্য যখনেতে যাদব শুনিল। নারীর চরণে পড়ে কান্দিতে লাগিল।। করিয়াছি অপরাধ তোমাকে জানাই। তোমা হেন নারী যেন জম্মে জম্মে পাই।। তাই দেখে শ্রীতারক সবাকে সান্তাল। শান্ত হয়ে দুই জনে সেবা করাইল।। গুরুসেবা করি তারা আনন্দে মাতিল। কান্দিয়া বিনোদ বলে হরি হরি বল।। তারকচাঁদের পানসী তরী খড়িয়া গ্রামেতে ছিল নিবারণ নাম। তারকের শিষ্য সেই ভক্ত গুণধাম।। একদিন তারকের পদ ধরি কয়। শুন বাবা বলি তোমা কি হবে উপায়।। অভাবের তাড়নায় কি করিব আমি। কি করিলে ভাল হবে বলে দাও তুমি।। তাই শুনে শ্রী তারক কহিল তখন। শুন তুমি নিবারণ আমার বচন।। ধানের ব্যাবসা তুমি কর মহাশয়। হাটে হাটে কেনা বেচা করিও সদায়।। তাহাতেই যাহা কিছু লভ্য তব হবে। সংসারের আয় ব্যয় তাহাতে চলিবে।। এতি বলি এক টাকা তার হাতে দিল। টাকা দিয়া তার হাতে কহিতে লাগিল।। ব্যাবসায় পুজি আমি দিলাম তোমায়। এক দরে কেনা বেচা করিও সদায়।। তাই শুনি নিবারণ চরণে পড়িল। চরণ ধরিয়া শেষে কহিতে লাগিল।। শুন বাবা বলি তোমা মরমের কথা। তোমার চরণ বিনে দাড়াইব কোথা।। যে দিনেতে তব পায় শরণ নিয়েছি। তোমার স্বরূপ আমি হৃদয় একেছি।। এক নিবেদন বাবা চরণে জানাই। অন্তিম কালেতে যেন শ্রীচরণ পাই।। তারক বলেছে বাছা মন ঠিক চাই। হরিচান্দের কৃপায় কোন চিন্তা নাই।। তাই শুনে নিবারণ গৃহেতে আসিল। তারকের কথা নিয়ে ব্যবসা করিল।। তারকের নাম নিয়ে প্রতি হাটে যায়। ধানের ব্যবসা করে আনন্দ হৃদয়।। চতুর্গুণ লভ্য হয় তারকের বরে। ঘরে ফেরে নিবারণ প্রফুল্ল অন্তরে।। এই ভাবে হাটে হাটে ব্যবসা করিত। তারক তারক বলে সদায় ডাকিত।। ধরে জনে পরিপূর্ণ ক্রমেতে হইল। তারপর জমি জমা কত যে রাখিল।। মাঝে মাঝে নিবারণ জয়পুর যায়। তারকের পদে গিয়ে সকল জানায়।। তাই দেখে শ্রী তারক আশির্বাদ করে। আশির্বাদ লয়ে শিরে ফিরে আসে ঘরে।। এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল। একদিনি নিবারণ শুনিতে পাইল।। লীলা সাঙ্গ করেছেন তারক গোঁসাই। তাই শুনে নিবারণ কেন্দে ছাড়ে হাই।। গড়াগড়ি যায় শেষে মাটিতে পড়িয়া। কেন বাবা চলে গেলে জগত ছাড়িয়া।। প্রাণের পুতুল তুমি চরণে জানাই। তোমা হেন দরদিয়া কোথা গিয়ে পাই।। পাগলের মত প্রায় বেড়ায় ঘুরিয়া। তারক তারক বলে বেড়ায় কান্দিয়া।। এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল। শান্ত হয়ে তারপরে ভাবিতে লাগিল।। তারকের নাম নিয়ে তরণী গঠিব। ধানের ব্যবসা আমি তাহাতে করিব।। সুন্দরীর কাঠ দিয়ে তরণী গঠিল। আগা নায় তারকের নাম লিখে দিল।। পাঁচ হাত মুখে হল সে তরণী খানি। নাম হল তারকের পানসী তরণী।। তারপর নিবারণ নৌকা সাজাইয়া। তারক চাঁদের নাম মানত করিয়া।। কয়জন ভাগি নিয়ে নৌকা সাবাইল। শুভ দিন বুধবার তরী খুলে দিল।। তারকের নাম নিয়ে তরণী বাহিয়া। চালনা বন্দরে ধান কিনিলেন গিয়া।। তারপর শেষে এসে করিত বিক্রয়। হাটে হাটে বিক্রি করে বহু লভ্য পায়।। এই ভাবে নিবারণ ব্যবসা করিত। তারক চান্দের নাম অন্তরে জপিত।। একদিন ধান কিনে দেশেতে আসিল। মন প্রতি দুই টাকা বাজার কমিল।। তাই দেখে নিবারণ মনেতে ভাবিয়া। তারক তারক বলে বেড়ায় কান্দিয়া।। একদিন নিশি যোগে স্বপনে দেখিল। তারক শিয়রে বসে কহিতে লাগিল।। শুন শুন নিবারণ বলি যে তোমারে। ধান বিক্রি কর তুমি এক মাস পরে।। এই কথা বলে তিনি অদৃশ্য হইল। নিদ্রা ভেঙ্গে নিবারণ ভাবিতে লাগিল।। ভাগীদের জানাইল স্বপনের কথা। তাই শুনে ভাগীগণ হল নিরবতা।। ঘাটেতে তরণী বেধে সবে গৃহে গেল। হাটে হাটে কেনা বেচা বন্ধ করে দিল।। নৌকা খানি ঘাটে বাধা কেহ নাহি রয়। তাই জেনে এক চোর ভাবিল হৃদয়।। কিছু ধান চুরি করে আনিব রাত্রিরে। তাই ভেবে সেই চোর লাগিল ঘুরিতে।। সন্ধ্যা হতে সেই চোর ঘোরা ফেরা করে। নৌকার নিকটে গেল দশটার পরে।। দেখিলেন নৌকা পরে বসি একজন। হুকা সেবা করিতেছে হয়ে একমন।। তাই দেখে সেই চোর জিজ্ঞাসে তাহারে। কেবা তুমি হুকা খাও বসে নৌকা পরে।। তাহা শুনে কহিলেন নৌকা পরে যেই। যার নৌকা বসে বসে হুকা খায় সেই।। তাই শুনে সেই চোর পিছাইয়া এল। নিবারণের বাড়ীতে আসিয়া দেখিল।। নিবারণ পাকঘর ভাত খাইতেছে। তাই দেখে সেই চোর মনেতে ভেবেছে।। নৌকার মালিক যেই গৃহেতে রহিল। নৌকা পরে কেবা সেই তামাক খাইল।। ইতি উতি কত কিছু মনেতে ভাবিয়ে। নৌকার নিকটে গেল দিশেহারা হয়ে।। নৌকা পরে ছিল যেই জিজ্ঞাসিল তারে। তব নাম কিবা হয় কহ আজ মোরে।। নৌকা পরে যেবা ছিল কহিল তখন। তারক আমার নাম শুন বাছাধন।। তাই শুনে সেই চোর পিছাইয়া এল। মালিকের কাছে গিয়ে সকল বলিল।। ধান চুরি করিবারে তব নায় যাই। নৌকায় পাহারা দেয় তারক গোঁসাই।। এত বলি নিবারণে কহিতে লাগিল। কেন্দে কেন্দে সেই চোর চরণে পড়িল।। নিবারণ ব্যাস্ত হয়ে চোরকে ধরিয়া। নৌকার নিকটে যায় কান্দিয়া কান্দিয়া।। দেখিলেন নৌকা পরে আর কেহ নাই। কল্কিতে আগুণ আছে দেখিলেন তাই।। তাই দেখে দুই জনে গড়াগড়ি যায়। তারক তারক বলে কান্দে দু’জনায়।। কান্দিয়া বিনোদ বলে বেলা ডুবে গেল। তারকের প্রীতে সবে হরি হরি বল।। মালসায় কবিগান খুলনা জেলার মধ্যে মালসা গ্রামেতে। জাগ্রত সে কালীমাতা বহু দিন হতে।। নাম করা কালীবাড়ী ছিল এ ধরায়। শত শত পাঠা বলি হইত তথায়।। পূজার দিবসে সেই পাঠা বলি হয়। পর দিন কবিগান হইত তথায়।। মন্দিরেতে মানত করিত কত জন। পূজার দিবসে তাহা করিত পালন।। একদিন তারকের বায়না হইল। কবিগান গাহিবারে তথায় চলিল।। নৌকা যোগে দল বল সঙ্গেতে করিয়া। পূজার দিবসে রাত্রি পৌছালেন গিয়া।। নৌকা হতে সে তারক একেলা নামিয়া। ছদ্ম বেসে মন্দিরেতে দেখিলেন গিয়া।। শত শত ছাগমুন্ড তথায় রয়েছে। ব্রাহ্মণেরা ভাগ নিয়ে দ্বন্দ্ব করিতেছে।। অজা রক্ত নালা বেয়ে নদীতে নেমেছে। থাকে থাকে সেই রক্ত জমিয়া রহেছে।। মনে মনে সে তারক ভাবিতে লাগিল। শত শত প্রাণী বধি মাকে পুজা দিল।। সন্তানের রক্ত দিয়ে পূজা যদি খায়। জগত জননী বলে কেন তারে কয়।। তাই ভেবে সে তারক পিছাইয়া এল। মনে মনে দুঃখ পেয়ে নৌকায় আসিল।। নৌকাতে দোঁহারগণ ছিল যত জন। তাহাদের ডেকে ডেকে কহিল তখন।। এই খানে গান করা দরকার নাই। নৌকা বেয়ে চল মোরা দেশে চলে যাই।। তাই শুনে কহিলেন সূর্য্যনারায়ণ। হেন কথা বল তুমি কিসের কারণ।। বায়না পেয়ে এসেছি গাহিবারে গান। না করিয়া গান মোরা ফিরে যাব ক্যান।। কত কষ্টে নৌকা বেয়ে আসিয়াছি হেথা। না বলিয়ে ফিরে গেলে লোকে পাবে ব্যাথা।। যদি তুমি যেতে চাও না করিয়া গান। শেষ রাত্রে নৌকা বেয়ে করিব প্রস্থান।। তারক বলেছে তুমি শুন মহাশয়। এই খানে যদি থাকি হইবে সংশয়।। কমিটিতে জানে যদি আসিয়াছি মোরা। কোন মতে যেতে মোরে দিবে না তাহারা।। তাই বলি মহাশয় কিছু দূরে যাও। সেই খানে নৌকা বেধে সকলে ঘুমাও।। তারপরে শেষ রাত্রে সকলে জাগিয়া। নৌকা বেয়ে যাব মোরা দেশেতে চলিয়া।। তাই শুনে সবে মিলে তাহাই করিল। কিছু দুরে গিয়ে তারা নৌকাটি বাধিল।। নৌকা পরে পাক করে করিল ভোজন। তারপর সবে মিলে করিল শয়ন।। আগা নায়ে সে তারক শয়ন করিল। কালীমাতা এসে তার শিয়রে বসিল।। পদ্ম হস্ত বুলাইয়া তারকের গায়। ডাক দিয়া কালীমাতা তারকেরে কয়।। শুন শুন শুন বাছা আমার বচন। মাকে ফেলে চলে যাবে কিসের কারণ।। মায়ের পরশ পেয়ে তারক জাগিয়া। মাকে দেখে বসিলেন বিমুখ হইয়া।। তাই দেখে কালীমাতা কহিল তখন। কেন বাছা বিষাদিত হইলে এমন।। তারক বলেছে মাগো বলি তব ঠাই। তব মুখ দেখিব না মনে ইচ্ছা তাই।। সন্তানেরে বলি দিয়া পূজা তুমি খাও। সে কারণে তব মুখ দেখিব না আমি।। সন্তানের রক্ত তুমি কর হে ভক্ষণ। জগত জননী তোমা বলে কোন জন।। তাই শুনে কালীমাতা কহিল তখন। এই পূজা কোনদিন করি না গ্রহণ।। ডাকিনী যোগিনী সদা এই পূজা খায়। আমি কভু কোনদিন থাকিনা হেথায়।। তারক বলেছে তুমি এই খানে রও। বর্তমানে দেখিতেছি কেন মিথ্যা কও।। তাই শুনে কালীমাতা বিনয়েতে কয়। তব গান শুনিবারে এসেছি হেথায়।। তুমি যদি চলে যাও না করিয়া গান। কি করিয়া আমি বাছা জুড়াইব প্রাণ।। তুমি বাছা নৌকা পথে করিলে গমন। সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছি শুন বাছাধন।। এই খানে আজি তুমি কবিগান গাও। গান গেয়ে তুমি মোর পরাণ জুড়াও।। তাই শুনে তারকের ঝরে আখি জল। কালীমার পদে পড়ি বলে হরি বল।। হেনকালে কালীমাতা হল অন্তর্ধান। কেন্দে কেন্দে শ্রী তারক হল অজ্ঞান।। ক্ষণেক চেতনা পেয়ে মনেতে ভাবিল। দোঁহারগণেরে ডেকে কহিতে লাগিল।। নৌকা ধয়ে চল সবে কালীবাড়ী যাই। শেষ রাত্রে তথা গিয়ে ভোর গোষ্ট গাই।। তাই শুনে কহিলেন সূর্য্য নারায়ণ। উম্মাদের মত কথা কহ কি কারণ।। সন্ধ্যায় কহিলে তুমি দেশে চলে যাব। এই খানে কোন মতে গান না করিব।। এখন কহিছ কেন কালীবাড়ী যাব। তোমার মনের ভাব কেমনে বুঝিব।। তাই শুনে সে তারক কহিল তখন। একে একে কহিলেন সব বিবরণ।। তাই শুনে সবে মিলে কান্দিতে লাগিল। কেন্দে কেন্দে তরী বেয়ে কালীঘাটে গেল।। ভোর বেলা নৌকা হতে সকলে নামিল। করিব খোলায় গিয়ে উপনীত হল।। ঢোল কাশি বাজাইয়া ভোর গোষ্ট গায়। তাই শুনে চারিদিকে জাগিল সবায়।। চারিদিকে হতে লোক আসিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে সেথা লোকারণ্য হল।। ভোর গোষ্ট গেয়ে পরে আগমনী গায়। তারপর গাহিলেন ভবানী বিষয়।। সেই গানে হরে নিল সবাকার প্রাণ। আখি জলে ভেসে ভেসে শোনে সেই গান।। কবির খোলায় যত শ্রোতাগণ ছিল। আনন্দেতে আত্মহারা প্রেমেতে মাতিল।। হেন দৃশ্য হল সেথা কহন না যায়। প্রেমেরে তরঙ্গে সবে ভাসিয়া বেড়ায়।। অলক্ষেতে বসে আছে কালীমাতা যিনি। নয়ন জলেতে ভেসে গান শোনে তিনি।। ওদিকেতে মন্দিরেতে পূজক ব্রাহ্মণ। মা’র চোখে জল ঝরে দেখিল তখন।। ঝর ঝর আখি জল ঝরিতে লাগিল। তাই দেখে সে ব্রাহ্মণ মাটিতে পড়িল।। কেন্দে কেন্দে কহিলেন মায়ের চরণে। তারকের গান শুনে কান্দ সে কারণে।। কান্দিয়া ব্রাহ্মণ গেল তারকের ঠাই। পদে পড়ে কহিলেন শুনহে গোঁসাই।। তব গান শুনে মাতা আখি জলে ভাসে। এ জীবন ধন্য হই তোমার পরশে।। তাই দেখে সে তারক ব্রাহ্মণে ধরিল। বুকেতে ধরিয়া তারে আলিঙ্গন দিল।। এহেন আশ্চর্য্য লীলা দেখিয়া নয়নে। শ্রোতাগণ সবে এসে পড়ে ধরাসনে।। কেহ কেহ কালীমার মন্দিরেতে গিয়ে। গড়াগড়ি যায় কেহ মাটিতে পড়িয়ে।। নারী কি পুরুষ তাহে নাহি ভেদ জ্ঞান। কেহ কার গায় পড়ে হতেছে অজ্ঞান।। প্রেমের রঙ্গ ওঠে আকাশ ভেদিয়া। মাতৃ হারা শিশু যেন বেড়ায় কান্দিয়া।। কেহ কেহ পড়ে গিয়ে তারকের পায়। তারকের পদে পড়ে কান্দিয়া ভাসায়।। তাই দেখে তারকের ঝরে আখি জল। আধ আধ ভাষা দিয়া বলে হরি বল।। বহু পরে প্রেমনিধি হইলেন শান্ত। তাই দেখে সে তারক গান করে ক্ষান্ত।। গান শেষে সে তারক হইল বিদায়। দল বল সঙ্গে করে দেশ চলি যায়।। অধম বিনোদ বলে পাঁচলিীর ছন্দে। তারকের ছবি খানি হৃদয়েতে বন্দে।। তাই বলি ভাই সব বেলা বেশি নাই। হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।। তারকচাঁদ পরশমণি হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ। তারক চাঁদের গুণ করিব বর্ণন।। পরশ পরশে যেন লৌহ সোনা হয়। তারকের পরশেতে পশু বৃত্তি ক্ষয়।। মানুষ মানুষ হয় তাহার পরশে। চোর সাধু হয়ে যায় তাহার বাতাসে।। তার কিছু তত্ত্ব কথা বলিব এখন। মধুর চরিত্র কথা শুন দিয়া মন।। সত্যবাদি জিতেন্দ্রিয় পুরুষ রতন। পরনারী মাতৃভাব সদা তার মন।। হরিচাঁদ পদ যুগ্ম হৃদয় ধরিয়া। দেশে দেশে কবিগান বেড়ায় গাহিয়া।। একদিন কবিগান গাহিবার তরে। দল বল লয়ে চলে কালিয়া বাজারে।। তিন দিন কবিগান হইবে তথায়। নৌকা যোগে কালিয়াতে হইল উদয়।। দলের দোঁহার ছিল সূর্য্য নারায়ণ। কাঙ্গালী বেপারী আর ভোলা সনাতন।। বিপক্ষের সরকার গোবিন্দ নামেতে। নাম করা কবিয়াল বিখ্যাত জগতে।। তাহার দলেতে ছিল সে মনমোহিনী। অতি সুমধুর ছিল তার কন্ঠধ্বনি।। বেশ্যা বৃত্তি ছিল তার পাপ কর্মে রত। গান শুনে সবাকার হয় মনমত।। কন্ঠস্বর ছিল তার অতি মধুময়। সে কারণে কাবিগানে বিখ্যাত সে হয়।। গোবিন্দ তাতীর দলে দোঁহারী করিত। সুকন্ঠ গাইকা বলে দলেতে রাখিত।। প্রথম দিনেতে কবি হইল তথায়। তরকের গুণগান সব লোকে কায়।। তাই শুনে চারিদিকে জনরব হলো। জ্ঞানীগুণী যত লোক তথায় আসিল।। ব্রাহ্মণ কায়স্থ আদি পণ্ডিত সমাজ। হিংসা বৃত্তি নিয়ে তারা আসিলেন আজ।। গোবিন্দ তাতীর দল গাহে যবে গান। কোন কিছু না বলিল পণ্ডিতের গণ।। তারক যখনেতে সেই আসরেতে গেল। শত শত প্রশ্ন তারা করিতে লাগিল।। তাই জেনে সে তারক শ্রীহরি স্মরিয়া। সে কথার যব দিল সুন্দর করিয়া।। এমন সুন্দর কথা শোনে নাই কেউ। সুমধুর কথা শুনে ওঠে প্রেম ঢেউ।। মহাভাব উথলিয়া কাব্য কথা কয়। তাই দেখে শ্রোতাগণ করে জয় জয়।। তারকের দেহ হতে জ্যোতি বাহিরায়। তাই দেখে কত জনে পড়িলেন পায়।। রামাগণে বাসা স্বরে উলুধ্বনি দেয়। প্রেমের তরঙ্গে সবে ভাসিয়া বেড়ায়।। জ্ঞানহারা প্রায় সেই পণ্ডিতের দল। আধ আধ ভাষা দিয়ে বলে হরি বল।। কেহ কেহ পড়িলেন তারকের পায়। মাটিতে পড়িয়া কেহ গড়াগড়ি যায়।। এই ভাবে প্রেম নিধি হইলেন শান্ত। তারপর সে তারক গান করে ক্ষান্ত।। জ্ঞানীগুণী শ্রোতাগণ একত্র হইয়া। রজত পদক এক গঠিয়া আনিয়া।। তাহাতে লিখিয়া দিল কবি রসরাজ। তারকের গলে দিল পণ্ডিত সমাজ।। জয় জয় ধ্বনি ওঠে আকাশ ভেদিয়া। রমাগণে উলুধ্বনি দিলেন আসিয়া।। তাই জেনে গোবিন্দের যতেক দোঁহার। মনে মনে বিষাদিত তাদের অন্তর।। গোবিন্দরে ডেকে বলে সে মনমোহিনী। তারকের জয় গান চারিদিকে শুনি।। আমাদের কন্ঠ ভাল সব লোকে কয়। তবে কেন তারকের হয় জয় জয়।। মোহিনীর কথা শুনে কহিল গোবিন্দ। তারকের জয় গানে কেন কর সন্ধ।। ব্রহ্মচারী মহাসাধু তারক গোঁসাই। তারকের কোন দিন পরাজয় নাই।। শক্তি যদি কোন দিন নষ্ট হয় যায়। সেই দিন তারকের হবে পরাজয়।। তাই শুনে মোহিনী ভাবে মনে মন। তারকের শক্তি আমি করিব হরণ।। আজি নিশি যাব আমি তারকের ঠাই। পরীক্ষা করিব আমি কেমন গোঁসাই।। গভীর রজনী দেখি মোহিনী চলিল। যে ঘরেতে সে তারক ঘুমাইয়া ছিল।। তারকের কোলে করে শুইল মোহিনী। কাম শক্তি জাগাইতে চেষ্ঠা করে ধনী।। তারকের দেহে যেই করিল পরশ। ভাবের উদয় হয়ে হইল অবশ।। তখন তারক চন্দ্র মা বলে ডাকিল। এত দিন পরে মাগো মনেতে পড়িল।। শিশু বেলা কোলে করে ঘামাতে আমায়। আজ বুঝি মনে পড়ে এসেছ হেথায়।। তই শুনে সে মোহিনী কান্দিতে লাগিল। অনুরাগ ভরে শেষে কান্দিয়া কহিল।। আমি যদি তব মাতা হই ধরা পরে। আর বার মা বলিয়ে ডাক বাবা মোরে।। এত যদি কহিলেন সে মনমোহিনী। মা মা বলিয়া ডাকে কবি চূড়ামণি।। তাই শুনে সে মোহিনী কান্দিতে লাগিল। আমার জনম ধন্য মনেতে ভাবিল।। বাৎসল্যেতে ভরপুর তাহার হৃদয়। নয়ন জলেতে তার বক্ষ ভেসে যায়।। কেন্দে কেন্দে চলিলেন গোবিন্দের কাছে। চরণে পড়িয়া শেষে কান্দিয়া বলেছে।।। শুন শুন মহাশয় বলি তব ঠাই। বিদায় কর হে মোরে দেশে চলে যাই।। শুনিয়া গোবিন্দ বলে মোহিনীর ঠাই। কেন তুমি চলে যাবে কহ মোরে তাই।। মোহিনী বলেছে আমি কবি না গাহিব। গৃহে থেকে আর আমি বাহিরে না যাব।। এই মাত্র তারকের মা হয়েছি আমি । আমি যদি কবি গাই হবে বদনামি।। জননী হইয়া যদি করি কবিগান। প্রকারেতে তারকের হবে অপমান।। তাই বলি মহাশয় চরণে জানাই। বিদায় কর হে মোরে দেশে চলে যাই।। তাই শুনে সে গোবিন্দ মনেতে ভাবিল। শুনিয়া সকল কথা বিদায় করিল।। বিদায় হইয়া শেষে দেশে চলে গেল। তারকের পরশেতে হরি ভক্ত হল। তারপর শুন এক আশ্চর্য্য ঘটনা। হরিভক্ত নিকটেতে করিব বর্ণনা।। তারকের গৃহে ছিল একটি বৃষভ। পশু জাতি বলে তার পশুর স্বভাব।। পশুদের ধর্ম আছে ধর্ম জ্ঞান নাই। মানুষের সব আছে শ্রেষ্ট হয় তাই।। বৃষভের নাম রাখে তারক গোঁসাই। শম্ভু শম্ভু বলে তারে ডাকিত সদাই।। ডাক দিলে কাছে এসে শ্রীঅঙ্গ চাটিত। অবলা সেই পশু জাতি ভালবাসা দিত।। একদিন গাভী আর বৃষভ সঙ্গেতে। সে নবগঙ্গায় চলে স্নান করাইতে।। অন্য এক গাভী ধায় ঋতুবতী হয়ে। তাই দেখে সেই শম্ভু চলিলেন ধেয়ে।। তাই দেখে শ্রী তারক দ্রুতগতি যায়। শম্ভুকে কহিছে তিনি হস্ত দিয়ে গায়।। তারকের পরশেতে কাম দুরে গেল। তারকের সঙ্গে এসে নদীতে নামিল।। তারপর স্নান করি গৃহতে চলিল। পশু পাখী যেন তার অনুগত ছিল।। এহেন পরশমণি আসিল জগতে। চোর সাধু হয়ে গেল তার পরশেতে।। অপুত্রকে পুত্র পায় তাহার কথায়। নির্ধনের ধন হয় তার করুণায়।। ভুত প্রেত মুক্তি পায় তার দরশনে। মহা ব্যাধি মুক্তি হয় তাহার স্মরণে।। এ দীন বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে। তারকের ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।। তাই বলি ভাই সব বেলা বেশী নাই। হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।। হিংসার প্রতিফল হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ। ঘটনা প্রবাহ এক করিব বর্ণন।। পদুমা গ্রামেতে ছিল কাঙ্গাল ব্যাপারী। তারক চান্দের দলে করিত দোঁহারী।। তাহার জেষ্ঠ্য ভায়ের এক কন্যা ছিল। উত্তম মণি নামেতে রূপে গুণে ভাল।। পিতা মাতা কেহ নাই কাঙ্গালী পালিত। কাঙ্গালীকে পিতৃজ্ঞানে সে মেয়ে ভাবিত।। কন্যাসম সে কাঙ্গালী করিত পালন। উত্তম বলিয়া তারে ডাকিত কখন।। এই ভাবে কত দিন গত হয়ে যায়। নয় বর্ষ গত হলে তারে বিয়ে দেয়।। বিবাহ হইল তার চালনা গ্রামেতে। বিধিলিপি ছিল যাহা কে পারে খণ্ডাতে। তৃতীয় বছরে তার স্বামী মারা গেল। বিধবা হইয়া শেষে পদুমায় এল।। শিশু বেলা যার পিতা মাতা মারা যায়। তার দুঃখ সারে নাক সব লোকে কয়।। এসময় সে কাঙ্গালী সে হইল প্রাচীন। আজ মরে কাল মরে দেহ হল ক্ষীণ।। উত্তম মণির দুঃখে কাঙ্গালী দুঃখিত। জলে ভরে আখি দু’টি তাহাকে কহিত।। শুন শুন শুন মাগো বলি তব ঠাই। সৎপথে থাক যদি কোন চিন্তা নাই।। আমি আর বেশি দিন রব না ধরায়। বিষয় সম্পদ যাহা দিলাম তোমায়।। হরিচাঁদ গুরুচাঁদ হৃদয় ধরিয়া। তারকেরে ভালবাস মনপ্রাণ দিয়া।। হরিভক্তগণ যদি আসে তব ঘরে। সেবা করাইবে সবে অতি সমাদরে।। হাতে কাম মুখে সদা হরি নাম লও। চরিত্র পবিত্র রেখে জীবন কাটাও।। এই ভাবে সে কাঙ্গালী কত বুঝাইল। কিছু দিন পরে সে যে জীবন তেজিল।। তারপর কত দিন গত হয়ে গেল। একদিন সে তারক পাদুমায় এল।। তারকেরে চক্ষে হেরি উত্তম তখন। মনপ্রাণ সপে দিয়ে করিত ভজন।। উত্তম মণির ঘরে তারক আসিত। দুই চারিদিন তথা আনন্দে থাকিত।। নিস্কাম নিয়মে তারে ভালবাসা দিত। ভালবাসা এড়াইয়া যেতে না পারিত।। এ সময় উত্তমের বয়স যৌবন। পচিশ ছাব্বিশ তার হবে অনুমান।। এই ভাবে সে তারক আসিত যাইত। পাড়া প্রতিবেশী তারা কত কি ভাবিত।। যে যেমন লোক সেই তেমন বুঝিয়া। যার যার মন কথা বেড়াত কহিয়া।। পাষণ্ডী যতেক লোক ভাবিত সদাই। কেমন মানুষ এই তারক গোঁসাই।। যুবতী মেয়ের সঙ্গে একি ব্যাবহার। এক ঘরে শুয়ে থাকে কেমন বিচার।। এই ভাবে কানাকানি করিত সকলে। ছিল এক মাতুব্বর তার কাছে বলে।। শুনিয়া সে মাতুব্বর ভাবে মনে মন। কৌশল করিয়া তারে মারিব পরাণে।। দুষ্ট লোক যত ছিল হয়ে একত্তর। পরামর্শ করিলেন সেই মাতুব্বর।। যেই দিন আসিবে সেই তারক গোঁসাই। আমি গিয়ে বলিব সেই উত্তমের ঠাই।। গোঁসাই এসেছে যদি মোর কথা লও। আমাদের লয়ে তুমি হরিলুট দাও।। মোর কথা শুনে সেই হরিলুট দিবে। সেই দিন সবে মিলে সেখানে আসিবে।। সেই খানে হরিনাম হইবে যখন। হরিনামে মাতোয়ারা হইবি তখন।। মাতোয়ারা হয়ে আমি দ্বীপ নিবাইব। তারকের পিছে গিয়ে আমি লুকাইব।। সেই ফাঁকে তোরা গিয়ে মুখে ঘুষি দিবি। মাটিতে ফেলিয়ে তারে প্রহার করিবি।। এই ভাবে পরামর্শ করিল সবাই। কিছুদিন পরে এল তার গোঁসাই।। তারকেরে চক্ষে হেরি উত্তম তখন। ভক্তিভরে ধোয়াইল যুগল চরণ।। বসিতে আসন দিল গৃহ মধ্যে নিয়া। সেবা করাইল তারে কান্দিয়া কান্দিয়া।। তাই যেনে পাষন্ডীরা কহিল তখন। উত্তম মণির কাছে করিল বর্ণন।। ভাল হল তব গৃহে আসিল গোঁসাই। হরিলুট দাও যদি আসিব সবাই।। তাই শুনে সে উত্তম তারকে জানায়। হরিলুট দিতে বলে গ্রামের সবাই।। তারক বলেছে তুমি হরিলুট দিবে। ভাল কাজ কর তুমি আর ভাল হবে।। তাই শুনে সে উত্তম তাহাই করিল। বাতাসা কিনিয়ে এনে নিমন্ত্রণ দিল।। নিমন্ত্রণ পেয়ে তারা সকলে আসিল। তারকেরে সঙ্গে করি লুট সাজাইল।। অন্তরেতে হিংসা নিয়ে আসিল সকলে। বাহিরে সরল ভাষা হরি হরি বলে।। সংকীর্তন করিতেছে সকলে মিলিয়া। হরিনাম করে তারা মাতিয়া মাতিয়া।। হেন কালে মাতুব্বর দ্বীপ নিভাইল। তাই দেখে সে তারক অদৃশ্য হইল।। হরি বলে ঘুষি মারে তারকে ভাবিয়া। মাতুব্বরের নাকে মুখে লাগিল আসিয়া।। নাকে মুখে রক্ত উঠে মাটিতে পড়িল। চারি দিক হতে সবে মারিতে লাগিল।। অন্ধকারে কেহ কারে চিনিতে না পারে। তালে তালে হরি বলে জোরে ঘুষি মারে।। মার খেয়ে মাতুব্বর অজ্ঞান হইল। কারে কারো হস্ত পদ ফুলিয়া উঠিল।। এই ভাবে অন্ধকারে এই কান্ড হয়। তারক বাহিরে এসে উত্তমেরে কয়।। কেবা কার মাথা খায় তারক কহিল। তাই শুনে উত্তমণি হাসিতে লাগিল।। হরি বলে ঘরে বসে সোর গোল হয়। অন্য লোক আলো জ্বেলে আসিল তথায়।। তারা সবে ঘরে গিয়ে দেখিবারে পায়। মোড়োলের দৃশ্য দেখে করে হায় হায়।। কার কার হস্তপদ ফুলিয়া উঠেছে। তারকেরে হিংসা করে কুফল ফলেছে।। তাই দেখে সবে এসে পড়িলেন পায়। তারকের পদে পড়ে গড়াগড়ি যায়।। কেহ কেহ কেন্দ কেন্দে তারকেরে কয়। ওগো বাবা কর ক্ষমা ধরি তব পায়।। তাই দেখে তারকের দয়া উপজিল। হরি বলে সে তারক ক্ষমা করে দিল।। সেই হতে তারা সবে হরি ভক্ত হল। অধম বিনোদ বলে হরি হরি বল।। তারকের সধনা হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ। অপূর্ব ঘটনা এক করিব বর্ণন।। নবগঙ্গা কুলে শোভে নামে কোলাগ্রাম। সেই গ্রামে বাস করে নবকৃষ্ণ নাম।। তার হয় চারি পুত্র কন্যা দুই জন। সাধনা নামেতে কন্যা অতি সু-শোভন।। সর্বগুণে গুণান্বিতা জেষ্ঠ্যা সেই হয়। মাধুর্য রসেতে ভরা তাহার হৃদয়।। তারকেরে ভালবাসে মনপ্রাণ দিয়ে। দৈব যোগে হল তার অন্যপাত্রে বিয়ে।। পরদিন গেল তার স্বামীর ঘরেতে। বিধাতার বিধি যাহা কে পারে খন্ডাতে।। সর্পাঘাতে তার স্বমী সে রাত্রি মরিল। বিধাবা হইয়া শেষে পিতৃ গৃহে এল।। তাই দেখে তার পিতা বিষাদিত মন। সাধনার দুঃখ দেখে ঝরে দুনয়ন।। পিতার চোখেতে জল দেখিল যখন। করপুটে সে সাধনা কহিল তখন।। শুন তুমি ওগো পিতা আমার বচন। বিধাতার বিধি যাহা কে করে খণ্ডন।। এই দেহ মন প্রাণ দিয়েছি যাহারে। আমার মনের মানুষ আছে ধরাপরে।। তারকেরে মনপ্রাণ দিয়াছি সপিয়া। দিবা নিশি কান্দে প্রাণ তাহার লাগিয়া।। সে যাহা কহিবে আমি তাহাই করিব। তাহার আদেশে আমি মনে শান্তি পাব।। তাই শুনে তার পিতা তাহাই করিল। তারকের কাছে গিয়ে সকল জানাল।। শুনিয়া সকল কথা তারক গোঁসাই। কোলা গ্রামে আসিলেন সাধনার ঠাই।। দেখিয়া সাধনা দেবী পড়িলেন পায়। নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।। শুন তুমি রসরাজ চরণে জানাই। তোমা বিনে এ জীবনে কোন শান্তি নাই।। এ জীবনে শুখ শান্তি যা কিছু আমার। আজ হতে সপিলাম চরণে তোমার।। তারক বলেছে তুমি শুন দিয়া মন। আমি যাহা বলি তুমি কর হে পালন।। সত্য পথে চল সদা সত্য কথা কও। হাতে কাম মুখে সদা হরিনাম লও।। নিস্কাম নিয়মে তুমি ভালবাস মোরে। মাধুর্য্যের পাত্র তুমি হও ধরা পরে।। মনে প্রাণে টানাটানি সতত রাখিবে। অলক্ষেতে সব কিছু জানিতে পারিবে।। মাধুর্য্য রসেতে ভরা তারকের মন। সাধনার সঙ্গে তাহা করিত যাজন।। এই ভাবে কত দিন গত হয়ে যায়। মনে প্রাণে টানাটানি থাকিত সদয়।। সাধনা সধনা করে অরোপে থাকিত। তারক যেখানে আছে দেখিতে পাইত।। তারক অরোপে তারে দেখিত নয়নে। যার যার তার তার মনে প্রাণে টানে।। এই ভাবে দুই জনে সাধনে তৎপর। মনে প্রাণে মিলাইত প্রেমের বাজার।। এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল। একদিন সাধনার পিতৃগুরু এল।। ব্রাহ্মণ সে কুলগুরু আসিল বাড়ীতে। সাধনা কে কহিলেন যতন করিতে।। পিতার আদেশ শুনে সাধনা তখন। গুরুদেবে সমাদরে করিল যতন।। পাক পাত্র ধৌত করি আনিয়া তখন। লেপিয়া পাকের ঘর করে আয়োজন।। পাক করিবারে গুরু সে ঘরেতে গেল। জল ছিটাইয়া গুরু পাক আরম্ভিল।। পাক করে সেই গুরু ভোজন করিতে। বারে বারে সাধনাকে লাগিল ডাকিতে।। ডাক শুনে সাধনা সে আসিল নিকটে। কি কারণে ডাকিতেছে কহে করপুটে।। কামাতুর সেই গুরু লাগিল কহিতে। প্রসাদ মাখিয়া তুমি দাও মোরে খেতে।। এক গ্রাস তুমি মোর মুখে তুলে দাও। তারপর যেথা ইচ্ছা সেথা চলে যাও।। তাই শুনে সে সাধনা লাগিল ভাবিতে। ঝর ঝর আখি দু’টি লাগিল ঝরিতে।। তারকে স্মরণ করি পিতার বাক্যেতে। একগ্রাস মুখে তুলি দিল ব্রাহ্মণ মুখেতে।। এ সময় সে তারক কবির খেলায়। কি করিলি ও সাধনা ডেকে ডেকে কয়।। এত ভালবাসি তোরে হারে রে সাধনা। কাম দেহ স্পর্শ করি দিলিরে যন্ত্রনা।। সেই খানে দোঁহারেরা ছিল যত জন। তার মধ্যে ডেকে বলে সূর্য্যনারায়ণ।। হেন কথা কেন তুমি কহিলে গোঁসাই। সাধনা সে কি করিল কহ মোরে তাই।। তাই শুনে সে তারক কহিল তখন। একে এসে কহিলেন সব বিবরণ।। তাই শুনে সকলেতে আশ্চার্য্য হইল। মনে মনে তারা সবে ভাবিতে লাগিল।। গোবরা কাছারী বসে মোরা গান গাই। সাধনা সে কি করিল দেখিল গোঁসাই।। গান শেষে মোরা সবে কোলগ্রোমে যাব। সত্য কিবা মিথ্যা হয় সকল জানিব।। গান শেষে সকলেতে বিদায় হইল। সবে মিলে কোলা গ্রামে উপনীত হল।। সাধনার কাছে গিয়ে সকল শুনিল। শুনিয়া সকলে তাই কান্দিতে লাগিল।। কান্দিয়া সকলে এসে পড়িলেন পায়। তারকের পদে পড়ে গড়াগড়ি যায়।। সাধনা আসিয়া যেই প্রণাম করিল। ক্রোধ ভরে সে তারক কহিতে লাগিল।। আমাকে ছুয়োনা তুমি শুন হে সাধনা। তব দেহ আর আমি স্পর্শ করিব না।। হেন কথা বারে বারে তারক কহিল। বজ্রসম সাধনার বুকেতে লাগিল।। অমিন সাধনা দেবী ধুলাতে লুটায়। বুক ভরা অভিমানে গড়াগড়ি যায়।। সঙ্গে যারা কহে তারা তারকের ঠাই। অবলারে ক্ষমা কর শুন হে গোঁসাই।। তারক বলেছে আমি ক্ষমা করে দিব। তার আগে সাধনাকে পরীক্ষা করিব।। এক খন্ড অগ্নি পিণ্ড হস্তেতে করিয়ে। একদন্ড থাকিবে সে এখানে দাড়ায়ে।। তাই শুনে সে সাধনা দ্রুতগতি গিয়ে। তেতুলের কাষ্ঠ অগ্নি আনিল ধরিয়ে।। তারকের ছবিখানি হৃদয় ধরিয়া। চক্ষু মুদি রহিলেন সেখানে বসিয়া।। মহাভাব উথলিয়া ভাসে আখি জলে। তারকের হস্তপরে অগ্নিতাপ জ্বলে।। হাতে ঠোষা পড়ে তাই ফুলিয়া উঠিল। অমনী তারক চন্দ্র কান্দিতে লাগিল।। কেন্দে কেন্দে সে তারক সাধনারে কয়। ফেলরে হাতের অগ্নি আর নাহি সয়।। শুনিয়া হাতের অগ্নি ফেলাইয়া দিল। অমনী তারক চন্দ্র বুকেতে ধরিল।। সাধনাকে বুকে ধরে ছাড়িতেছে হাই। তোমা হেন প্রাণ প্রিয়া কোথা গিয়ে পাই।। তাই শুনে সে সাধনা কান্দিয়া ভাসায়। তারকের পদধরী কেন্দে কেন্দে কয়।। এ জীবন মন প্রাণ দিয়েছি তোমায়। জনমে জনমে যেন পদে মতি রয়।। হেন দশা হল সেথা কহন না যায়। মাটিতে পড়িয়া সবে করে হায় হায়।। সূর্য্যনারায়ণ আর কাঙ্গালী বেপারী। তারকের পদে পড়ে যায় গড়াগড়ি।। উঠিল প্রেমের বন্যা স্রোত বয়ে যায়। প্রেমের তরঙ্গে সবে ভাসিয়া বেড়ায়।। হরি হরি বলে সবে কান্দিতে লাগিল। বহুক্ষণ পরে সবে সুস্থির হইল।। তারপর সে সাধনা সান্তনা পাইয়া। সবাইকে খেতে দিল আনন্দে মাতিয়া।। সকলে আনন্দ ভরে করিয়া ভোজন। যার যার দেশে সবে করিল গমন।। এই ভাবে কত দিন গত হয়ে যায়। মাঝে মধ্যে সে তারক আসিত তথায়।। এই ভাবে কোলাগ্রামে আসিত গোঁসাই। দুই এক দিন থাকে সাধনার ঠাই।। তাই দেখে গ্রাম্য লোকে ভাবিত সবাই। কেমন মানুষ এই তারক গোঁসাই।। সধনা অসতী তাই সকলে ভাবিত। এই ভাবে কানাকানি সবাই করিত।। স্বজাতি ভোজন যদি কোন খানে হত। পাক করিবারে সেথা সাধনা থাকিত।। একদিন একবাড়ী স্বজাতি ভোজন। সমাজের যত লোক হোল নিমন্ত্রণ।। সামাজিক যত লোক আসিয়া তথায়। এক ঠাই বসে তারা সবাকে জানায়।। সাধনা করিলে পাক মোরা খাইব না। চরিত্রহীনা নারী সে সকলের জানা।। এই কথা যখনেতে সাধনা শুনিল। সবার মধ্যোতে এসে কহিতে লাগিল।। করো জোড়ে বিণয়েতে কহলি ভারতী। এই গ্রামে যত নারী সব হয় সতী।। আসিয়া করুক পাক বিনা ওড়োনেতে। খালি হাতে পাক হবে দেখিব চক্ষেতে।। তাই শুনে যত নারী আসিতে না চায়। সাধনা কহিছে তবে কি হবে উপায়।। আমি গিয়ে করি পাক বিনা ওড়োনেতে। হরি বলে করি পাক সবার স্বাক্ষাতে।। হেন কথা যখনেতে সাধনা কহিল। তাই শুনে গ্রাম্য লোকে কহিতে লাগিল।। উত্তপ্ত তেলের মধ্যে তব হস্ত দিয়া। নাড়িয়া করিবে পাক দেখিব থাকিয়া।। তাই যদি পার তুমি পাক কর গিয়া। না পারিলে মোরা সব দিব দেখাইয়া।। তাই শুনে সে সাধনা করিবারে পাক। প্রাণভরে হরিচাঁদে দিল এক ডাক।। তারকের ছবিখানি হৃদয়ে ধরিয়া। নয়ন জলেতে ভেসে পাক করে গিয়া।। চুলা জ্বালাইয়া দিয়া কেন্দে কেন্দে কয়। কোথা মোর হরিচাঁদ রেখ রাঙ্গা পায়।। তারক তারক বলে কান্দিতে কান্দিতে। তপ্ত তেলে হাত দিয়া লাগিল নাড়িতে।। ডাল তরকারি মধ্যে হাত দিয়া নাড়ে। আগুনেতে সাধনার হাত নাহি পোড়ে।। সাধনার অঙ্গ হতে জ্যোতি বাহিরায়। তাই দেখে সব লোকে কান্দিয়া ভাসায়।। মা বলিয়া সাধনারা চরণে পড়িল। চরণ ধরিয়া শেষে কান্দিতে লাগিল।। কেন্দে বলে ওগো মাতা বলি তব ঠাই। তোমাসম সতী নারী এ জগতে নাই।। না জানিয়া তোমা প্রতি দোষ করিয়াছি। সমোচিত ফল মোরা প্রত্যক্ষে পেয়েছি।। কত কি বলেছি মাগো আগে না বুঝিয়া। ক্ষমা কর ওগো মাতা সন্তান বলিয়া।। এই ভাবে সবে এসে পদে ক্ষমা চায়। নয়নের জলে সবে কান্দিয়া ভাসায়।। তাই দেখে সাধনার দয়া উপজিল। হাসি মুখে সে সাধনা ক্ষমা করে দিল।। তারপর সে সাধনা রন্ধন করিয়া। সবাই কে খাওয়াইল আনন্দে মাতিয়া।। ভোজন করিয়া সবে কহিল তখন। এমন স্বাদের খাদ্য খাইনি কখন।। সেই হতে সাধনাকে মা বলে ডাকিত। ছোট বড় সকলেতে ভকতি করিত।। কোলাগ্রাম ধন্য হল সাধনার গুণে। আনন্দে মাতিল যত হরিভক্তগণে।। হরিভক্ত ছিল সেই লোচন গোঁসাই। সাধনাকে মা বলিয়া ডাকিত সদিই।। সে বস বৃত্তান্ত কথা লীলামৃতে আছে। নিজ হাতে শ্রী তারক তাহা লিখিয়াছে।। সাধনার সাধনায় হরিভক্তগণ। সাধনার গুণগান করেন কীর্তন।। অধম বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে। তারকের ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।। তাই বলি ভাই সব বেলা বেশী নাই হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।। ভেকের মুক্তি শ্রীহরি স্মরিয়া আমি, গুরুচাঁদ পদে নমি (লাইন জ্ঞাপ) তারকের চরিত্র সুধা, মিটাইতে ভব ক্ষুধা আশীর্বাদ কর ভক্তগণ।। হরিভক্ত যত জন, বন্দি সবার চরণ শ্রীচরণে করি নিবেদন। হরিভক্ত কৃপাকরে, বসিয়া মস্তক ‘পরে সঙ্গে থেকে করিও লিখন। যশোহর জেলা পরে, নবগঙ্গা নদী তীরে লক্ষ্মীপাশা গ্রামখানি ছিল। লক্ষ্মীপাশা কালি বাড়ী, নাম ছিল দেশ জুড়ি সে কারণে বিখ্যাত হইল।। সেই গ্রামে একজন, পুকুর করে খনন কুয়াতিরা মাটি কাটিতেছে।। ছয় হাত মাটি তলে, দেখিতে পায় সকলে ফোস ফোস শব্দ হইতেছে। কিছু মাটি ফেলে দিল, সকলে দেখিতে পেল শোয়া হাত পরিমাণ হবে। বড় এক ভেক দেখি, সকলে ভাবিল একি মনে মনে সকলেতে ভাবে।। গায় দেখে চেট ভরা, বুঝিতে না পারে তারা এত বলি ডাকিল সকলে। জ্ঞানীগুণী ছিল যারা, আসিয়া দেখিল তারা যে যেমন বোঝে তাই বলে।। এক জন ডেকে কহে, এত কভু ভেক নহে এত বড় ভেক কভু হয়। অন্য প্রাণী হবে ভাই, মোর মনে জাগে তাই ভাল করে দেখরে সবায়।। একজন ডেকে কয়, ভেক ছাড়া কিছু নয় সব কিছু ভেকের আকৃতি। বহুদিন পড়ে রয়, তাই এত বড় হয় না বুঝিয়া কহ যে অযুক্তি।। এই ভাবে কত জন, করে সথো আগমন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এল কত। কহিলেন কত কথা, যুক্তিতে আসিল না তা। কহে যত যার যার মত।। সেই খানে ছিল যারা, সবে হল দিশেহারা সুরেন্দ্র নামেতে একজন। সে কহিল সকলেরে, এই কথা কহিবারে পারে মাত্র তারক সুজন।। এই কথা শুনি কানে, কহিল পণ্ডিতগণে হেসে হেসে কহিল তখনে। আদ্য মধ্য আছে কত, সবে হল থতমত তারক সে পারিবে কেমনে।। কাড়ার যাজির ছেলে, কবি গায় তাই বলে হেন তত্ব ক্যামনে কহিবে। শুনিয়ে সে ঘটনা, কোন মতে আসিবেনা পার যদি আন গিয়ে সবে।। একজন তথা গিয়ে, তারকেররে প্রণমিয়ে কহিল সকল সমাচার। শুনিয়া তারক তাই, কেমনে আমি যাই আমি হই জাতিতে কাড়ার।। মোর বিদ্যা বুদ্ধি নাই, সেথা পণ্ডিত সবাই আমি হই ক্ষুদ্র একজন। আমি সেথা নাহি যাব, কেন অপমান হব বল গিয়ে আমার বচন।। তাই শুনে চলে গেল, সব গিয়ে নিবেদিল কহিল সে তারক গোঁসাই। বড় বড় পণ্ডিতেরা, সেখানে রয়েছে তারা বলিলেন পণ্ডিত সবাই। তাই শুনে পণ্ডিতেরা, হাসিতে লাগিল তারা হাসিয়া কহিল একজন। আমাদের আছে জানা, সে কখন আসিবে না তার দ্বারা হবে না কখন।। সুরেন্দ্র শুনিয়ে তাই, কহিলেন আমি যাই কেন আসিবে না সেই জন। চলিলেন ধীরে ধীরে, গিয়ে সেই জয়পুরে তারকের করিল বন্দন। কহিলেন বিনয়েতে, চল বাবা মোর সাথে চল তুমি লক্ষ্মীপাশা গায়। তুমি যদি নাহি যোবে, এ জীবনে কিবা হবে এ জীবন ত্যাজিব নিশ্চয়।। হেন কথা শুনি কানে, কি যেন ভাবিয়া মনে সুরেন্দ্রের সঙ্গেতে চলিল। ঘটনার স্থলে গিয়ে, ভেকেরে দেখিল চেয়ে সভা মধ্যে দাড়ায় কহিল।। শুন শুন সভাজন, করি আমি নিবেদন আমি হই কড়ারের ছেলে। হরিচাঁদ পদ ভাবি, হৃদয়ে আঁকিয়া ছবি এই তত্ত্ব আমি যাই বলে।। কর্ম ফলে কত লোক, পায় তারা দিব্য লোক কর্ম ফলে হয় রাজরাণী। কর্ম ফলে রাজ্য হারা, অন্ধ খঞ্জ সবে তারা কর্ম ফলে হয় ধনীমানী।। মানব জনম ধরি, কেহ করে গুরুগিরি কেহ কেহ শিষ্য হয়ে রয়। পূর্ব জম্মে ভেক ছিল, গুরুগিরি করে ভাল ব্রাহ্মণের ছেলে সেই হয়।। বহু শিষ্য ছিল তার, করে গুরু ব্যাভিচার ব্যাভিচারে মত্ত হয়েছিল। নৌকা পথে চলে তারা, ডুবিল পাপের ভরা কর্ম ফলে ভেক রূপী হল।। চেট হল শিষ্য যারা, চেয়ে দেখ গায় ভরা কর্ম ফল ফলিয়াছে ভাল। তাই শুনে সেই ভেকে, ঠিক ঠিক ওঠে ডেকে আখি জলে ভাসিতে লাগিল।। ভেক ভাসে আখি জলে, তাই দেখি কেন্দে বলে পেয়ারী নামেতে যেই ছিল। শুনিতে বাসনা আজ, কহ তুমি রসরাজ কিসে ভেক মুক্তি পাবে বল।। শুনিয়া তারক কয়, হরি বলি রসনায় শুন তাই কিসে মুক্তি পাবে। হরিভক্ত দরশনে, হরি ভক্ত পরশনে সর্বপাপ মুক্ত হয়ে যাবে।। হেন কথা শুনে কানে, ভেক ভাবি মনে মনে লাফ দিয়ে চরণে পড়িল। তারকের পড়ি পায়, প্রাণ পাখি উড়ে যায় চেটগণ পরাণ তেজিল।। হেন দৃশ্য চোখে হেরি, সবে যায় গড়াগড়ি তারকেরে চরণে লুটায়। ধনীমানী ছিল যারা, সবে হয়ে আত্মহারা নয়নের জলে ভেসে যায়।। ভক্তি রসে মাতোয়ারা, নয়নে বহিছে ধারা তারকের করে জয়গান। ভেকেরে ধরিয়া তুলে, ফেলে দিল গঙ্গা জলে সাঙ্গ ভেক মুক্তির আখ্যান।। হরি ভক্ত যারা যারা, প্রেম রসে মাতোয়ারা পরশনে সর্বপাপ ক্ষয়। কান্দিযা বিনোদ বলে, এ জনম গেল চলে অধমের কি হবে উপায়।। স্বপনে তারক চাঁদ হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ। তারক চাঁদের কথা করিব বর্নণ।। তারকের নাম নিলে শমন পালায়। তাহার স্মরণে হয় সর্ব ব্যাধি ক্ষয়।। তার কিছু তত্ত্ব কথা বলিব এখন। আশ্চর্য্য ঘটনা এক করিব বর্ণন।। যশোহর জেলা মধ্যে মাগুরার কাছে। দোয়ানী নামেতে গ্রাম সেই খানে আছে।। সেই গ্রামে বাস করে শ্রী নকুল নাম। সরল হৃদয়খানি ভক্ত গুণধাম।। তাহার রমণী ছিল নামে লক্ষ্মী দেবী। মনেতে আনন্দ পায় স্বামী পদ সেবী।। সর্বগুণে গুণান্বিতা লক্ষ্মী দেবী হয়। সে নকুল সদা ভাসে আনন্দ দোলায়।। জমা জমি যাহা কিছু ছিল যে তাহার। ভালভাবে চলে যেত তাহার সংসার।। এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল। লক্ষ্মীর গর্ভেতে এক পুত্র জনমিল।। সে গ্রামের চারিপাশে যত গ্রাম আছে। তারক গোঁসাই এসে গান করিতেছে।। কবিগান করে সেথা তারক গোঁসাই। তারকের গুণগান করিত সবাই।। জ্ঞানীগুণী যারা ছিল শুনি তার গান। প্রাণভরে শুনে তারা জুড়াইত কান।। তাই শুনি লক্ষ্মী দেবী মনেতে ভাবিয়া। তারকে হেরিব আমি কেমন করিয়া।। তারকের নাম গুণে ঝরে আখি জল। কেমনে হেরিব আমি চরণ যুগল।। উদ্দেশে তারক পদে প্রণাম জানায়। নামগুণে হৃদয়েতে প্রেমের উদয়।। এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল। দৈব যোগে ছেলেটির রোগ দেখা দিল।। প্রাণাধিক সেই ছেলে ভালবাসে তারা। প্লিহা জ্বরে ক্রমে ক্রমে হল জীর্ণ জ্বরা।। পাড়া গায় ডাক্তার ছিল না তখন। ঝাড়া পোছা মুষ্টি যোগ করে সর্বক্ষণ।। আজ মরে কাল মরে অস্থি চর্ম সার। জীবনের আশা ছেড়ে দিল যে এবার।। মনে মনে লক্ষ্মী দেবী তারকে স্মরিয়া। এই ভাবে সেই নারী বেড়াত কান্দিয়া।। একদিন স্বপনেতে দেখিতে পাইল। তারক আসিয়া তার শিয়রে বসিল।। হাসি মুখে সে তারক কহিল তখন। আসিব তোমার ঘরে মোরা কয় জন।। আগামী সকালে তুমি করিবে রন্ধন। তব ঘরে ভোজন করিব চারি জন।। স্বপনে দেখিয়া লক্ষ্মী প্রভাতে জাগিয়া। স্বামীর নিকটে গিয়া কহিল কান্দিয়া।। স্বপনেতে দেখিয়াছি মানুষ রতন। মস্তকেতে উভ ঝুটি সুন্দর গঠন।। মুখ ভরা শছতার প্রেমের মুরতী। মম ঘরে আসিবেন হইয়া অতিথি।। চারিজন খাব মোরা আমাকে বলেছে। পাক করা অনুমতি চাই তব কাছে।। নকুল বলেছে তুমি দেখেছ স্বপন। তব মনে যাহা ইচ্ছা কর হে পালন।। তাই শুনে সেই লক্ষ্মী রন্ধন করিল। হেন ক্ষণে তিন জন তথায় আসিল।। তারক কাঙ্গালী আর সূর্য্যনারায়ণ। তাই দেখে সেই লক্ষ্মী ভাবে মনে মন।। স্বপনেতে কহিয়াছে চারিজন কথা। আসিয়াছে তিন জন আর জন কোথা। স্বামীর চরণে গিয়ে কেন্দে কেন্দে কয়। স্বপনে দেখেছি যারে এসেছ হেথায়।। হেন কথা সেই মেয়ে বলিতে বলিতে। তারকের পদধরি লাগিল কান্দিতে।। তাই দেখে সে নকুল চরণে পড়িল। চরণ ধরিয়া শেষে কান্দিতে লাগিল।। তারক ধরিয়া তুলে কহিল তখন। বড় ক্ষুধা লাগিয়াছে করিব ভোজন।। তাই শুনে সেই মেয়ে উঠিয়া দাঁড়াল। ছল ছল আখি দু’টি কান্দিয়া কহিল।। স্বপনে বলেছ তুমি পাক করিবারে। রন্ধন করিয়া আমি রাখিয়াছি ঘরে।। এত বলি সেই মেয়ে কান্দিয়া কান্দিয়া। ভোজনের ঠাই করে আসন পাতিয়া।। তিনটি আসন পেতে করে দিল ঠাই। তাই দেখে কহিলেন তারক গোঁসাই।। আর এক খানি পিড়ি আনিয়ে পাতাও। ঘরে আছে তব ছেলে তাহারে বসাও।। এক সঙ্গে চার জন ভোজন করিব। তার দেহে যত রোগ আমি নিয়ে যাব।। তাই শুনে দুই জনে কান্দিয়া ভাসায়। মৃতপ্রায় সেই ছেলে আনিয়া বসায়।। লক্ষ্মী দেবী অন্য দেয় হরষিত মন। আনন্দে ভোজন করে সেই চার জন।। মুখে রুচি পেয়ে সেই ছেলেটি খাইল। সবাই সমান খেল সকলে দেখিল।। সেই হতে সে ছেলের রোগ দুরে গেল। হরিবলে সেই ছেলে নাচিতে লাগিল।। তাই দেখি স্বামী স্ত্রী কান্দিয়া ভাষায়। তারকের পদে পড়ে গড়াগড়ি যায়।। তারক বলেছে মাগো মন খাটি চাই। হরিচাঁদের কৃপায় কোন চিন্তা নাই।। সেই হতে তারা সবে হরিভক্ত হল। এ দীন বিনোদ বলে হরি হরি বল।। চন্দ্রকান্তের গুরু ভক্তি হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ। হরিভক্ত গুণ কথা করিব বর্ণন।। নলিয়ারচর গ্রাম খুলনা জেলায়। তেরখাদা থানা মধ্যে সেই গ্রাম হয়।। সেই গ্রামে বাস করে চন্দ্রকান্ত নাম। তারকের প্রীয় শিষ্য ভক্ত গুণধাম।। কি ভাবেতে তারকের সঙ্গেতে মিলন। তার কিছু তত্ব কথা শুন দিয়া মন।। কালিয়া থানার মধ্যে চালনা গ্রামেতে। কবিগান হবে সেথা শুনিয়া কর্ণেতে।। কবিগান শুনিবার করিল গমন। পথে যেতে কত কিছু ভাবে মনে মন।। কবিগান গাবে সেথা তারক গোঁসাই। নাম শুনে ভাল লাগে চোখে দেখি তাই।। এই ভাবে কত কিছু ভাবিতে ভাবিতে। উদয় হইল গিয়া চালনা গ্রামেতে।। বিপক্ষের সরকার আনন্দ নামেতে। দূর্গাপুর তার বাড়ী বিখ্যাত কবিতে।। দুই দল উঠিলেন কবির খেলায়। শত শত শ্রোতাগণ হয়েছে উদয়।। দুই দল সমকক্ষ গান করিতেছে। গান শুনে শ্রোতাগণে আনন্দে ভেসেছে।। আনন্দ নামেতে সেই সরকার ছিল। গান করি সে আনন্দ বাহিরেতে এল।। তারক উঠিল যবে কবির খেলায়। হেন কালে দিনমণি অস্তাচলে যায়।। সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসিল গগনে। তারক গাহিছে গান শ্রোতাগণ শোনে।। হেন কালে মশকেরা দলে দলে এল। মশার কামড়ে সবে অস্থির হইল।। হাতের চাপড়ে সবে মশা মারিতেছে। চট পট আসরেতে শব্দ হইতেছে।। তাই শুনে শ্রী তারক কহিল তখন। নাড়াচাড়া কর সবে কিসের কারণ।। আসেরেতে যত লোক কহিল তখন। মশার কামড়ে মোরা কি করি এখন।। তাই শুনে সে তারক উচ্চস্বরে কয়। শুন শুন মশাগণ থেক না হেথায়।। হরিচাঁদের দোহাই শুন মশাগণ। এ আসরে কোন দিন এস না কখন।। তাই শুনে সেই মশা কোথায় লুকাল। শ্রোতাগণ তাই দেখে আশ্চর্য্য হইল।। তার পরে সে তারক ধরে ধুয়া গান। ধুয়া গানে হরে নিল সবাকার প্রাণ।। প্রমের তরঙ্গ ওঠে আকাশ ভেদিয়া। তার মধ্যে শ্রোতাগণ বেড়ায় ভাসিয়া।। কেহ এসে পড়িলেন তারকের পায়। নয়ন জলেতে ভেসে গড়াগড়ি যায়।। কেহ কেহ বলিতেছে তারকের জয়। কেহ বলে হরিচাঁদ গুরুচাঁদ জয়।। জয় জয় ধ্বনি ওঠে আকাশ ভেদিয়া। হরি বলে নাচে কেহ দুবাহু তুলিয়া।। এই ভাবে বহুপরে গান ক্ষান্ত হল। যার যার গৃহে সবে গমন করিল।। শুধু একা বসে আছে চন্দ্রকান্ত হীরা। জ্ঞানহারা প্রায় তার বহে অশ্রুধারা।। কি করিবে কোথা যাবে ভাবিয়া না পায়। অন্ধাকার রাত্রি দেখে রহিল তথায়।। চাদোয়ার তলে সে যে শয়ন করিল। একটি মশায় তারে কামড় নাই দিল।। সেই হতে সেই মাঠে মশা নাহি হয়। প্রত্যক্ষ দেখিছি আমি থাকিয়া তথায়।। তারকের গুণ কথা বলি কি ভাষায়। স্মরণ করিলে হয় প্রেমের উদয়।। তারপর চন্দ্রকান্ত প্রভাতে জাগিয়া। ছল ছল আখি দু’টি কান্দিয়া কান্দিয়া।। তারক যে বাড়ি ছিল সে বাড়ীতে গিয়ে। তারকের পদে পড়ে কহিছে কান্দিয়ে।। আজ হতে তব পায়ে নিলাম শরণ। দয়া করে চল বাবা আমার ভবন।। তারক বলেছে বাছা কোথা বাড়ী ঘর। চন্দ্রকান্ত বলে বাড়ী ললিয়ার চর।। চন্দ্রকান্ত নাম মম হীরা বংশ হয়। যুধিষ্ঠির পুত্র আমি দিনু পরিচয়।। তারক বলেছে তবে মনে যদি চায়। কিছু দিন পরে যাব তোমার আলয়।। কবির বায়না মোর আছে কত ঠাই। এর মধ্যে যেতে মোর সময় তো নাই।। বৈশাখ মাসেতে যাব তোমার বাড়ী। এত বলি সে তারক দিল ধার্য্য করি।। তাই শুনি চন্দ্রকান্ত প্রণাম করিল। পদধুলি লয়ে শিরে গৃহেতে আসিল।। তারকের ছবিখানি হৃদয় ধরিয়া। আশা পথ পানে থাকে সতত চাহিয়া।। এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল। বৈশাখ মাসেতে সেই তারক আসিল।। সঙ্গে ভক্ত আসিলেন আর কয়জন। কাঙ্গালী বেপারী আর সূর্য্যনারায়ণ।। ব্রাহ্মণ সে জগদিশ পবিত্র ছিঁড়িয়া। তারকেরে গুরু করি আসিল মিশিয়া।। যাদব মল্লিক আর শ্রী যাদব ঢালী। শ্রী নবীন রাধাক্ষেপা আর বনমালী।। হরি হরি বলে সবে বাড়ীতে উঠিল। দেখিয়া সে চন্দ্রকান্ত চরণে পড়িল।। পরিবারসহ এসে চরণে লুটায়। মেয়েরা আসিয়া সেথা উলুধ্বনি দেয়।। প্রণাম করিয়া সবে চরণ ধোঁয়ায়ে। বসিবারে দিল সবে আসন পাতিয়ে।। তারপর চন্দ্রকান্ত মনেতে ভাবিয়া। এ পাড়ায় ও পাড়ায় বেড়ায় ঘুরিয়া।। ডাব খাওয়াবে বলে গাছারু সন্ধানে। কাহারে না পেয়ে শেষে দুঃখ পায় মনে।। তাই জেনে কহিলেন তারক গোঁসাই। শুন বলি চন্দ্রকান্ত তোমাকে জানাই।। বৃথা কেন ঘোরা ফেরা কর মহাশয়। দাও নিয়ে চলে যাও গাছের গোড়ায়।। হরিচাঁদ গুরচাঁদ স্মরণ করিয়া। শিকড়েতে কোপ দাও নয়ন মুদিয়া।। তাই শুনে চন্দ্রকান্ত কান্দিয়া ভাসায়। দাও নিয়ে চলিলেন গাছের গোড়ায়।। হরিচাঁদ গুরুচাঁদ তারকে স্মরিয়া। শিকড়তে কোপ দিল নয়ন মুদিয়া।। এক কোপে তিন খনি শিকড় কাটিল। তিন ছড়া নারিকেল মাটিতে পড়িল।। তাই দেখে সবে মিলে মানিল বিস্ময়। তারকের পদে পড়ে কান্দিযা ভাসায়।। কেহ কেহ কেন্দে কেন্দে ধরণী লুটায়। কেহ কারে বক্ষে ধরি আলিঙ্গন দেয়।। কেহ এসে তারকের চরণে পড়িল। চরণ ধরিয়া শেষে কান্দিয়া কহিল।। তোমার চরণে বাবা এই ভিক্ষা চাই। জীবনে মরণে যেন ভুলিয়া না যাই।। পুরুষ রমণী যারা ছিল সেই খানে। কেন্দে কেন্দে অচৈতন্য হল সর্বজনে। তাই দেখে সে তারক সবাকে সান্তায়। চেতনা করায় সবে হস্ত দিয়া গায়।। তারপর চন্দ্রকান্ত কান্দিয়া কান্দিয়া। সেই ডাব খেতে দেয় কাটিয়া কাটিয়া।। সু-মিষ্ট ডাবের জল খাইল সকলে। আনন্দেতে সবে তরা হরি হরি বলে।। কেহ বলে হরিচাঁদ গুরুচাঁদ জয়। কেহ বলে হরিভক্তগণ জয় জয়।। কেহ বলে তারক চান্দের জয় জয় কেহ উঠে দাড়াইয়া হরিধ্বনি দেয়। মেয়ে লোক যত ছিল করে উলুধ্বনি। হরি হরি বলে যত ধনীমানী জ্ঞানী।। তারপর সবে মিলে সুস্থির হইল। মেয়েরা সকলে মিলে রন্ধন করিল।। ব্যাস্ত হয়ে করিলেন ভোজনের ঠাই। ভোজনে বসিল গিয়ে সাধুরা সবাই।। ধূপ ধুনা নিয়ে এল রামমণি যিনি। সেই নারী হলে চন্দ্রকান্তের রমণী।। রামমণির চক্ষু জলে ভাসিতে লাগিল। তারকের পদে পরে কান্দিয়া কহিল।। ওগো বাবা কর ক্ষমা অবলা বলিয়া। ভক্তি নাই জ্ঞান নাই পুজিব কি দিয়া।। তারক বলেছে মাগো মন খাটি চাই। হরিচান্দের কৃপায় কোন চিন্তা নাই।। এই ভাবে ভক্তি করি ভোজন করায়। একজন দাঁড়াইয়া হরিধ্বনি দেয়।। সাধু সাবধান বলে কেহ ভীর দিল। এই ভাবে আনন্দেতে ভোজন করিল।। তারপর আচমন করিয়া সবাই। হরিকথা কহিলেন বসি এক ঠাই।। তারপর সবে মিলে কীর্তনে মাতিল। হরিগুণ গান করি সে নীশি বঞ্চিল।। প্রভাতে উঠিয়া সবে হরিগুণ গায়। চন্দ্রকান্ত পড়িলেন তারকের পায়ে।। কেন্দে বলে ওগো বাবা বলি তব ঠাই। মনের বাসনা আজি চরণে জানাই।। মন্দির করেছি আমি মোর কথা লও। তুমি আজ নিজ হাতে ঘট পেতে দাও।। তাই শুনি সে তারক কহিল তখন। তোমার বাসনা আমি করিব পূরণ।। তাই শুনে চন্দ্রকান্ত নব বস্ত্র এনে। ভক্তি ভাবে অর্পিলেন তারক চরণে।। তারপর শ্রী তারক ঘট পেতে দিল। পূজার পদ্ধিতি সব তারে জানাইল।। রামমণি চন্দ্রকান্ত আসিয়া বসিল। হরি নাম মন্ত্র গিয়া দীক্ষা কে করিল।। তাই দেখে সবে মিলে হরিধ্বনি দিল। তারপর শ্রী তারক বাহিরে আসিল।। বাহিরে আসিয়া তিনি বলিল তখন। একটি বেলের চারা আন হে এখন।। তাই শুনে চন্দ্রকান্ত ঘুরিয়ে বেড়ায়। মন্দির পিছনে গিয়ে দেখি বারে পায়।। একটি বেলের চারা তথায় রয়েছে। সেই চারা এনে দিল তারকের কাছে।। নিজ হাতে সেই চারা করিল রোপন। কহিলেন এই গাছ করিও যতন।। এই গাছ বড় হলে ফল যদি হয়। সেই ফল লাগাইও ঠাকুর সেবায়।। তারপর সবে মিলে করিয়া ভোজন। চন্দ্রকান্তে ডাক দিয়া কহিল তখন।। শুন বাবা চন্দ্রকান্ত তোমাকে জানাই। বিদায় কর হে মোরে জয় পুর যাই।। চন্দ্রকান্ত বলে বাবা তোমাকে জানাই। পদে যেন থাকে ভক্তি এই ভিক্ষা চাই।। মহোৎসব করিতে মনে মোর চায়। তুমি দিন করে দিলে বাঞ্ছা পূর্ণ হয়।। তারক বলেছে বাছা মঙ্গল হইবে। পহেলা বৈশাখে তুমি উৎসব করিবে।। এই কথা যখনেতে তারক কহিল। সকলে তারক পদে প্রণাম করিল।। তারপর বলে কয়ে হইল বিদায়। ভক্তগণ সঙ্গে করে জয় পুর যায়।। সেই হতে চন্দ্রকান্ত বছরে বছরে। পহেলা বৈশাখে তিনি সাধু সেবা করে।। এইভাবে কত দিন গত হয়ে গেল। একদিন শ্রীতারক এসে দেখা দিল।। দেখিয়া সে চন্দ্রকান্ত প্রণমিল পায়। রামমণি তিনি এসে চরণ ধোঁয়ায়।। চরণ ধোঁয়ায়ে সে বসিবারে দিল। ধূপ ধুনা দিয়ে তিনি প্রণাম করিল।। পাক করিবারে পরে করে আয়োজন। হেন কালে চন্দ্রকান্ত ভাবে মনে মন।। কি দিব কি দিব বলে মনেতে ভাবিয়া। বাড়ীর দক্ষিণ পার্শ্বে উতরিল গিয়া। কাঠাল গাছেতে তিনি উঠিলেন গিয়ে। পাকিয়াছে কিনা তাই দেখেছে টিপিয়ে।। পাকে নাই সে কাঠাল দেখিলেন তাই। মন দুখে ফিরে এল ছাড়ে শুধু হাই।। কিছু পরে শ্রী তারক কহিল তখন। চন্দ্রকান্ত ডেকে বলে মধুর বচন।। কাক ডাকিতেছে বাছা কাঠালের গাছে। যাও বাছা দেখি গিয়ে কাঠাল পেকেছে।। তাই শুনে চন্দ্রকান্ত চলিল তথায়। কাকেতে ঠোকর মারে কাঠালের গায়।। গাছে উঠে সে কাঠাল আনিল পাড়িয়া। কিভাবে কি হয়ে গেল না পায় ভাবিয়া।। কিছু আগে দেখিলাম হস্তেতে টিপিয়া। অতিশয় শক্ত ছিল দেখেছি আসিয়া।। অল্প সময়ের মধ্যে নরম হিইল। তারকের গুণে বুঝি কাঠাল পাকিল।। তাই ভেবে চন্দ্রকান্ত কান্দিয়া ভাসায়। গৃহে এলো সে কাঠাল করিয়া মাথায়।। আখি জলে ভেসে ভেসে কাঠাল ভাঙ্গিয়া। তারকেরে খেতে দিল কান্দিয়া কান্দিয়া।। হরিচাঁদ গুরুচাঁদ স্মরণ করিয়া। তারক কাঠাল খায় পরাণ ভরিয়া।। এইভাবে চন্দ্রকান্ত ভকতি করিত। মাঝে মাঝে শ্রী তারক তথায় আসিত।। এই ভাবে কত খেলা খেলিল তারক। কলমেতে কি লিখিব আমি অপারক।। চন্দ্রকান্ত শ্রীতারক লীলা সাঙ্গ পরে। কি ঘটনা হল সেথা বলিব সবারে।। মহানন্দ নামে চন্দ্রকান্তের তনয়। পিতার আদর্শ মেনে চলিত সদায়।। পহেলা বৈশাখ হলে সাধু সেবা দেয়। দলে দলে মতুয়ারা আসিত তথায়।। তারক যে বেল গাছ রোপন করিল। সেই গাছ বড় হয়ে ফল ধরেছিল।। সেই ফল লাগাইতে ঠাকুর সেবায়। প্রতিবর্ষ বৈশাখেতে মহোৎসব হয়।। একদিন শুন এক আশ্চর্য্য ঘটনা। হরিভক্ত কাছে আমি করিব বর্ণনা।। দলে দলে মতুয়ারা তথায় আসিল। বেল গাছ ছায়াতলে কীর্তন করিল।। সেই বেল ভোগে দিতে ভুল হয়ে গেছে। গাছ হতে পাকা বেল মাটিতে পড়েছে।। শত শত হরিভক্ত সেই খানে ছিল। কারো গায় না পড়িল মাটিতে পড়িল।। তাই দেখে হরিভক্ত মানিল বিস্ময়। মহানন্দ হীরা কান্দে পড়িয়া ধরায়।। কেন্দ কেন্দে কহিলেন ভক্তগণ ঠাই। ভূল হয়ে গেছে মোর সবাকে জানাই।। সেই বেল নিয়ে শেষে ভোগেতে লাগায়। কেহ কেহ হরি বলে নাচিয়া বেড়ায়।। এহেন আশ্চর্য্য লীলা দেখিয়া নয়নে। হরিভক্ত কান্দে কেহ পড়ে ধরাসনে।। এইভাবে কীর্তনেতে সকলে মাতিল। বহুক্ষণ পরে শেষে কীর্তন থামিল।। এই ভাবে সাধু সেবা হইত তথায়। তারক চাঁদের গুণ কি লিখি ভাষায়।। অধম বিনোদ বলে বেলা বেশি নাই। হরিচান্দ প্রীতে সবে হরিবল ভাই।। তারকের পরশে কাটা গাছ বাড়ে হরিচাঁদ লীলা খেলা কে বোঝে ধরায়। কার দ্বারা কিবা করে হরি দয়াময়।। হরি হতে নাম বড় এ ভব সংসারে। নাম হতে ভক্ত বড় জানাই সবারে।। হরিভক্ত গুণ কথা কহন না যায়। হরিভক্ত দরশনে প্রেমের উদয়।। তার কিছু তত্ত্ব কথা কহিব এখন। ঘটনা প্রবাহ এক করিব বর্ণন।। হরিভক্ত শিরোমণি তারক গোঁসাই। লীলামৃত গ্রন্থখানি যার দ্বারা পাই।। কবিগান করে তিনি দেশ দেশান্তর। হরিচাঁদ গুণ কথা করেন প্রচার।। একদিন চলিলেন খুলনা জেলায়। রামপাল থানা মধ্যে হলেন উদয়।। দল বল সঙ্গে করে হাটিতে হাটিতে। উদয় হইল গিয়ে হুকড়া গ্রামেতে।। পথিমধ্যে চারিজন লোক বসা ছিল। তারকে হেরিয়া তারা কান্দিয়া কহিল।। এই দেশে আমাদের চেনা জানা নাই। বিপদে পরিয়া মোরা তোমাকে জানাই।। আমাদের বাড়ী হয় ঘৃতকান্দি গায়। করাতির কাজে মোরা এসেছি হেথায়।। হরিচাঁদ ভক্ত তুমি তারক গোঁসাই। তুমি বিনে এ বিপদে আর কেহ নাই।। রূপচাঁন্দ নামে এই গ্রামে একজন। তার বাড়ী কাজ করি শুন বিবরণ।। দশদিন এই বাড়ী কাজ করিতেছি। একগাছ ছেও দিয়ে বিপদে পড়েছি।। কথাছিল দশ ফুট ছেও দিতে হবে। ঠিকমত গাছখানি চেরাই করিবে।। ঠিকমত মাপ দিয়ে কাটা হয়ে গেল। হেন কালে রূপচাঁন্দ তথায় আসিল।। নিজ হাতে রূপচাঁন্দ মাপিয়া দেখিল। চারি ইঞ্চি গাছখানি কম পড়ে গেল।। নিজে রাও মেপে দিখে চারি ইঞ্চি কম। বারে বারে মাপিলাম হয় ব্যাতিক্রম।। তাই দেখে রূপচাঁন্দ গালাগালি দিয়া। আমাদের অস্ত্র গুলি রাখে ঘরে নিয়া।। আমাদের টাকা কড়ি কিছু নাহি দেয়। তাই মোরা বসে আছি হয়ে নিরুপায়।। তাই শুনে সে তারক তাহাদের নিয়ে। কাটা গাছ যথা আছে উত্তরিল গিয়ে।। হরিচাঁদ ছবিখানি হৃদয় ধরিয়া। সেই গাছে হাত দিয়া কহিছে কান্দিয়া।। শুন শুন গাছ তুমি মোর কথা লও। চারি ইঞ্চি বেড়ে তুমি ঠিক মত হও।। বলা মাত্র সেই গাছ বাড়িতে লাগিল। চারি ইঞ্চি বেড়ে গাছ ঠিকমত হল।। এত বলি শ্রীতারক তাদের কহিল। মাপকাঠি আন দেখি কত কম পল।। তাই শুনে করাতিরা মাপ কাঠি নিয়ে। ঠিকমত গাছখানি দেখিল মাপিয়ে।। দেখিলেন সকলেতে গাছ কম নাই। তারকের পদে পড়ে কেন্দে ছাড়ে হাই।। তারক বলেছে সব সুস্থ্য কর মন। মালিকেরে ডেকে আন গিয়ে একজন।। তাই শুনে একজন গমন করিল। দ্রুত গতি গিয়ে তারে ডাকিয়ে আনিল।। রূপচাঁন্দে ডেকে বলে তারক গোঁসাই। কিবা অপরাধ করে ইহারা সবাই।। চারি ইঞ্চি কম গাছ ইহারা কেটেছে। তব মাপ মনে হয় ভুল হয়ে গেছে।। তাই শুনে রূপচাঁন্দ কি যেন ভাবিয়া। মাপ কাঠি দিয়ে গাছ দেখিল মাপিয়া।। বারে বারে মেপে দেখে ঠিক মত হয়। তারকের কাছে এসে পদে ক্ষমা চায়।। মনে হয় আগে আমি ভুল মাপিয়াছি। সকলের কাছে আমি ক্ষমা চাহিয়াছি।। তাই শুনে শ্রীতারক কহিল তখন। শুন সবে মন দিয়া আমার বচন।। দয়া ছাড়া ধর্ম নাই এভব সংসারে। ক্ষমা যদি চায় কেহ ক্ষমা কর তারে।। তাই শুনে রূপচাঁন্দ কহিল তখন। শুন ভাই করাতিরা আমার বচন।। মোর এই গাছ খানি করহে চেরাই। তোমাদের টাকাকড়ি সব দিব ভাই।। তারকেরে কহিলেন করিয়া বিনয়। মম গৃহে চল তুমি ওগো মহাশয়।। তারক বলেছে আমি দেরি না করিব। এই গ্রামে আমি আজ কবিগান গাব।। এত বলি শ্রীতারক গমন করিল। রূপচাঁন্দ তারকের পদে প্রণমিল।। তারকের পদে যেই পরশ করিল। কি যেন কি আকর্ষণে প্রেম সঞ্চারিল।। সেই হতে গৃহে গিয়ে ভাবিতে লাগিল। তারকের ছবিখানি হৃদয় জাগিল।। কবিগান হবে সেথা দক্ষিণ পাড়ায়। মন বড় উচাটন চলিল তথায়।। তারকের গান শুনে ঝরে আখি জল। মহাভাব উথলিল বলে হরি বল।। সবে দেখে রূপচাঁন্দ দুর্জয় মানুষ। গান শুনে কান্দিতেছে হইয়া বেহুষ।। ধরা ধরি করে সবে সান্তনা করিল। তীর বেগে ছুটে গিয়ে চরণে পড়িল।। তারকের পদে পড়ে কান্দিয়া ভাষায়। অপরাধ করিয়াছি রেখ রাঙ্গা পায়।। তোমাকে চিনিতে মোর সাধ্য কিছু নাই। আমার মনের কথা তোমাকে জনাই।। তোমার পরশে কাটাগাছ বেড়ে যায়। আমা হতে সেই কথা হইল প্রত্যয়।। আগে আমি না জানিয়া ভুল করিয়াছি। আজ হতে তব পায় শরণ নিয়েছি।। দস্যু মন ছিল মোর আসিয়া সংসারে। তোমার পরশে আজ সব গেল দুরে।। এত বলি রূপচাঁন্দ কান্দিতে লাগিল। তারক ধরিয়া তাকে সান্তনা করিল।। সান্তনা করিয়া বলে শুন বাছাধন। মোর প্রতি সদা যেন থাকে তব মন।। হরিচাঁদ গুরুচাঁদে স্মরণ করিবে। হাতে কাম মুখে নাম সত্য পথে রবে।। হেন কথা রূপচাঁন্দ যখন শুনিল। তারকের চরণেতে প্রণাম করিল।। পদ ধুলি অঙ্গে মেখে গুহেতে চলির। গান শেষে শ্রীতারক বিদায় হইল।। এইভাবে কতদিন গত হয়ে যায়। রূপচাঁন্দ মনে প্রাণে ভাবিত হৃদয়।। আর কবে হেরিব সে মানুষ রতন। দিবানিশি সদা করে মন উচাটন।। সংসার বন্ধন হতে কবে মুক্ত হব। তারকের পদে গিয়ে আত্ম সমর্পিব।। একদিন রূপচাঁন্দ প্রভাতে জাগিয়া। তারকের ছবিখানি হৃদয় ধরিয়া।। জয়পুর যাব বলে করিল গমন। ভাবে গদগদ চিত্ত ঝরে দু’নয়ন।। চারিদিন পরে গিয়ে হইল উদয়। তারকের পদে পড়ে গড়াগড়ি যায়।। কেন্দে বলে ওগো বাবা করি নিবেদন। কৃপা করে অধমের কর হে গ্রহণ।। তারক ধরিয়া তবে রূপচাঁন্দে কয়। হরিনাম মহামন্ত্র দিলাম তোমায়।। হাতে কাম মুখে দাম্পত্য কথা কবে। পবিত্র চরিত্র রেখে সংসার করিবে।। তারপর শ্রীতারক কত শিক্ষা দিল। ভোজন করিয়া সবে নিশি কাটাইল।। পর দিন তথা হতে ভোজন করিয়া। ওড়াকান্দি করে যাত্রা রূপচান্দে নিয়া।। রূপচাঁদ কাছে গিয়ে দিল দরশন।। গুরুচাঁদ চরণেতে প্রণাম করিল। হাসি মুখে গুরুচাঁদ কহিতে লাগিল।। শুন বলি রসরাজ তোমাকে জানাই। রূপচান্দ হবে পরে রমণী গোঁসাই।। তাই শুনে রুপচান্দ চরণে পড়িল। গুরুচাঁদ পদ ধরি কান্দিতে লাগিল।। কেন্দে বলে ওগো প্রভু করি নিবেদন। চিরদিন তব পদে থাকে যেন মন।। আমি অতি মুঢ়মতি কোন গুণ নাই। তব পদ আমি যেন ভুলিয়া না যাই।। অহংকারে মত্ত হয়ে কত কি করেছি। গুরু পদ পরশেতে কি যেন হয়েছি।। পরশ পরশে যেন লৌহ সোনা হয়। সে মত হয়েছে মোর পাষাণ হৃদয়।। এইভাবে রূপচাঁন্দ কান্দিতে লাগিল। গুরুচাঁদ ধরে তুলে সান্তনা করিল।। গুরুচাঁদ বলে শুন ওগে বাছা ধন। ভক্তি পথে থাকে যেন সদা তব মন।। হাতে কাম মুখে নাম মন খাটি চাই। পরনারী মাতৃরূপ দেখিবে সদাই।। প্রশস্থ গার্হস্থ ধর্ম পালন করিবে। চরিত্র পবিত্র রেখে সত্য কথা কবে।। এইভাবে গুরুচান্দ কত বুঝাইল। দু’জনারে ল’য়ে শেষে বাড়ী মধ্যে গেল।। সত্য ভাষা চরণেতে প্রণাম করিয়া। যার যার দেশে সবে গেলেন চলিয়া।। অধম বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে। গুরুচাঁদ ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।। তাই বলি ভাই সব বেলা বেশি নাই। হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।। তারকচাঁদের তিরধান ও সূক্ষ্মদেহে দর্শণ হরি-গুরুচাঁদ বন্ধি যুগল চরণ। তারকের লীলা গীতি করিব বর্ণন।। হরিভক্ত শিরোমণি তারক গোঁসাই। যাহার মস্তকে থাকে ক্ষীরোদের সাই।। সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় পুরুষ রতন। শোক তাপ দুরে যায় করিলে স্মরণ।। প্রশস্থ গার্হস্থ্য ধর্ম পালন করিত। নামে রুচি জীবে দয়া সবে শিক্ষা দিত।। বিবাহ করিল তিনি ঠাকুরের মতে। এক কন্যা জন্ম নিল তাহার গর্ভেতে।। চিন্তামণি নামে ভার্যা পতি পরায়ণা। পতি পদ ভিন্ন সতী কিছুই জানেনা।। তারকের আজ্ঞা মতে সতত চলিত। স্বভক্তি অন্তরে সতী চরণ সেবিত।। এক কন্যা সেই গর্ভে যখন জন্মিল। শংকরী বলিয়া নাম তাহার রাখিল।। পুত্রের বাসনা তার নাহি ছিল মনে। তারকের কথা মতে চলে তার সনে।। কন্যাটিকে যত্ন করি পূর্ণ অভিলাষ। আর না করিল সতী স্বামী সহবাস।। এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল। ক্রমে ক্রমে সেই কন্যা বাড়ীতে লাগিল।। শংকরী কে বিয়ে দিয়ে রাখিল বাড়ীতে। এক পুত্র জন্ম নিল তাহার গর্ভেতে।। সে পুত্রের নাম রাখে শৈলেন্দ্র বলিয়া। তারক রাখিল নাম কি যেন ভাবিয়া।। পুত্র পেয়ে শংকরীর ভরে ওঠে বুক। কোলে করে সেই পুত্র কত পায় সুখ।। এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল। দিনে দিনে সেই পুত্র বাড়িতে লাগিল।। তারকেরে দাদু বলে ডাকিত যখন। কোলে করে তারকের আনন্দিত মন।। মুখে চুমু দিয়ে তারে ভালবাসা দিত। ভালবাসা পেয়ে শিশু আনন্দে হাসিত।। তাই দেখে সাবাকার আনন্দিত মন। সুখের সাগরে ভাসে তারক সুজন।। এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল। শংকরী ডাকিয়া তার পিতাকে কহিল। আমার ছেলের লাগি জুতা কিনে দাও। বার বার বলি আমি দিব দিব কও।। তারক বলেছে মাগো পরবাসে যাই। দেশে দেশে আমি শুধু কবিগান গাই।। আসিবার কালে মাগো মনেতে থাকে না। কিনিব কিনিব বলে কিনিতে পারিনা।। শংকরী বলেছে বাবা শুন মোর কথা। মরে গিয়ে দিবে নাকি মোর পুত্রে জুতা।। তারক বলেছে মাগো হতে পারে তাই। জুতা কিনে দিব আমি কোন চিন্তা নাই।। তারপর কতদিন গত গয়ে গেল। সেই জুতা কোন দিন কিনিয়ে না দিল।। তারপর দেশে দেশে ঘুরিতে লাগিল। ঠাকুরের যুগধর্ম পালন করিল।। গীতি কাব্য লিখিলেন মহাসংকীর্তন। শুনিলে জীবের হয় শমন দমন।। হরি লীলামৃত গ্রন্থ মধুর আখ্যান। ভক্তগণে শোনে তাহা অমৃত সমান।। এই ভাবে হরিনাম প্রচার করিয়া। শুভক্ষেণে চলিলেন জগত ছাড়িয়া।। একদিন ঘুম হতে প্রভাতে জাগিয়া। হরিনাম করিতেছে কান্দিয়া কান্দিয়া।। সবে দেখে হরিনাম করিতে করিতে। প্রাণ পাখী উড়ে গেল দেখিতে দেখিতে।। আত্ম পরিজন সবে কান্দিয়া ভাষায়। ব্রহ্মরন্ধ্র ফেটে গেছে দেখিবারে পায়।। তেরশ একুশ সালে ফাল্গুন মাসেতে। শিব চতুর্দশী তিথি চড়িপুষ্প রথে।। চলিলেন রসরাজ ঠাকুরের পাশে। দীর্ঘ শ্বাস ছাড়িতেছে আকাশে বাতাসে।। নর নারী যারা ছিল কান্দিয়া ভাসায়। আকাশে সাতাসে যেন হরিগুণ গায়।। গ্রাম বাসি যারা ছিল করে হায় হায়। এহেন দরদী মোরা পাইব কোথায়।। সোনার মানুষ গেল জগত ছাড়িয়া। কেমনে বাঁচিব মোরা শোক পাশরিয়া।। এই ভাবে কতজন কান্দিয়া ভাসায়। শংকরী মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি যায়।। কেন্দে বলে ওগো বাবা আখি মেলে চাও। কোন দেশে যাবে তুমি মোরে কয়ে যাও।। চিন্তামণি কান্দিতেছে চরণে পড়িয়া। কেন তুমি ছেড়ে গেলে দাসীকে ফেলিয়া।। সতী নারী পতি বিনে কিছু নাহি চায়। কি বুছিয়া ছেড়ে গেলে ফেলিয়া আমায়।। অভাগিনীর মিনতী চরণে জানায়। আমি আর বেশি দিন রব না ধরায়।। কৃপা করে নিও স্বামী তোমার নিকটে। কেন্দে কেন্দে চিন্তামণি কহে করপুটে।। তাই শুনে গ্রাম বাসি সবাকে বুঝায়ে। শব দাহ করিলেন শ্মশানেতে নিয়ে।। হরিবলে চিতা জ্বেলে করিল দাহন। চন্দনের বিন্দু বিন্দু হয় বরিষণ।। চন্দনের বৃষ্টি হয় দেখিল সকলে। আশ্চর্য্য মানিয়া সবে হরি হরি বলে।। কেহ কেহ হরি বলে কান্দিয়া ভাষায়। আকাশে বাতাসে যেন হরিগুণ গায়।। এই ভাবে দাহ কার্য্য সমাধা হইল। শোক পাশরিয়া সবে গৃহেতে আসিল।। তারপর সামাজিক প্রথা অনুসারে। শ্রাদ্ধ কার্য্য করিলেন দশদিন পরে।। তারপর কি হইল শুন দিয়ে মন। ঘটনা প্রবাহ আমি করিব বর্নণ।। দিঘলিয়া গ্রাম বাসি জগদীশ নাম। তারকের প্রিয় শিষ্য ভক্ত গুণধাম।। বাড়ী শ্রেণী ভুক্ত সেই ব্রাহ্মণ নন্দন। পৈতা ফেলে করিলেন আত্মসমর্পণ।। মাদারীপুরেতে গেল সেই মহাশয়। দৈব যোগে তারকের সনে দেখা হয়।। দেখিয়া সে জগদীশ প্রণাম করিল। কোথায় চলেছে বাবা মোর কাছে বল।। তারক বলেছে বাছা বলি তব ঠাই। হরিবলে আজি আমি ব্রহ্মপুত্রে যাই।। একজোড়া জুতা কিন আনিয়াছি আমি। সঙ্গে করে এই জুতা লয়ে যাও তুমি।। মোর নাতি শৈলেন্দ্রেরে এই জুতা দিও। কবে ফিরি ঠাই নাই তাহাকে কহিও।। জুতা নিয়ে জগদীশ গৃহেতে আসিল। পর দিন জুতা নিয়ে জয়পুর গেল।। তিন দিন আগে সেই তারক গোঁসাই। শুনিলেন ছেড়ে গেছে এ জগতে নাই।। তাই শুনে জগদীশ মাটিতে পড়িল। চেতনা পাইয়া শেষে কান্দিয়া কহিল।। গত কাল জুতা কিনে মোর কাছে দিল। মাদারীপুরেতে বসে আমাকে কহিল।। কবে আমি দেশে ফিরি তার ঠিক নাই। বুঝিলাম শেষ দেখা দিলেন গোঁসাই।। তাই শুনে সবে মিলে কান্দিয়া ভাসায়। মাটিতে পড়িয়া সবে গড়াগড়ি যায়।। হেন দশা হল সেথা কহন না যায়। গ্রাম বাসী সবে এসে করে হায় হায়।। শংকরী কান্দিয়া বলে সকলের ঠাই। বাবা যাহা বলে ছিল করে গেল তাই।। শুন বাবা বলি তোমা হৃদয়ের কথা। কাহারে বুঝাব আমি পিতৃহারা ব্যাথা।। চিন্তামণি কান্দিতেছে হা নাথ বলিয়া। কি খেলা খেলিলে তুমি জগত ছাড়িয়া।। তোমার বিরহ ব্যাথা সহিব কেমনে। বলে যাও ওগো স্বামী জানাই চরণে।। এই ভাবে কেন্দে কেন্দে সবে শান্ত হল। সেই জুতা যত্ন করি মন্দিরে রাখিল।। যত্ন করি সেই জুতা সেবা ভক্তি করে। এইখনে সেই জুতা আছে সে মন্দিরে।। অধম বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে। তারকের ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।। তাই বলি ভাই সব বেলা ডুবে গেল। হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি হরি বল।। কঙ্কালে সাধনা হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ। ঘটনা প্রবাহ এক করিব বর্নণ।। সাধনা ভাই সব কোলা গ্রামে ছিল। সবে মিলে ভিটা ছেড়ে জয়পুরে এল।। পশ্চিম পাড়ায় এসে বসত করিত। ভ্রাতৃ অন্নে একসনে সাধনা থাকিত।। শ্রীতারক যখনেতে ত্যাজিল জীবন। কি যেন কি হয়ে গেল সাধনার মন।। বিরহ আগুণে পুড়ে মন ঠিক নাই। তারক তারক বলে সদা ছাড়ে হাই।। হাহুতাসে কান্দে সদা তারক বলিয়া। পাগলিনী প্রায় শেষে বেড়াত কান্দিয়া।। অল্প দিন পরে শেষে ত্যাজিল জীবন। তারকের পিছে পিছে করিল গমন।। শোক পাশরিয়া সবে সমাধি করিল। অবিলম্বে শতকাজ সকল হইল।। বাড়ী পরে রাখিলেন যতন করিয়া। ধুপ দ্বীপ দেখাইত সকলে মিলিয়া।। এই ভাবে কত দিন গত হয়ে যায়। তারপর কি হইল লিখিব ভাষায়।। ভারত বিভাগ হয়ে দুই খন্ড হল। পাকিস্তান ছেড়ে কেহ ভারতে চলিল।। সাধনার ভাই সব এমন সময়। ভিটা বাড়ী বিক্রি করি ভারতেতে যায়।। মুসলমান কিনিল সেই বাড়ী ঘর। তাহারা বসতি করে সেই বাড়ী পর।। সাধনার সমাধিটি বাড়ীর পাশেতে। তুলসীর বৃক্ষ ছিল তাহার পরেতে।। মিয়ারা কবর ভাবি সেখানে না যায়। জঙ্গলেতে পরিণত হইল তথায়।। এই ভাবে কতদিন গত হয়ে যায়। তারপর কি হইল লিখিব ভাষায়।। তেরশত আশি সাল হবে অনুমান। আশ্চর্য্য ঘটনা এক হয়েছে প্রমাণ।। রাজেন্দ্র নামেতে ছিল জয়পুর বাসি। তারক চাঁদের নামে হইল উদাসি।। সাধনাকে মনে মনে মা বলে ডাকিত। ধ্যানে জ্ঞানে মনে প্রাণে ভকতি করিত।। একদিন নিশি যোগে স্বপনে দেখিল। সাধনা আসিয়া তারে কহিতে লাগিল।। শুন শুন বাছাধন বলি যে তোমায়। আমার সমাধি পরে ভক্তি যেন রয়।। সকালে বিকালে তুই সেই খানে যাবি। পরিস্কার করে সেথা ভকতি করিবি।। সন্ধ্যা বেলা ধুপ দ্বীপ সেখানে দেখাবি। আমার কৃপায় তুই মঙ্গলে থাকিবি।। এই ভাবে তিন দিন স্বপনে কহিল। পরদিন ভোর বেলা তথায় চলিল।। সমাধির পরে যেই আবর্জনা ছিল। নিজ হাতে পরিস্কার তখনে করিল।। ছল ছল আখি দু’টি প্রণাম করিয়া। পুনরায় আসিলেন গৃহেতে ফিরিয়া।। সন্ধ্যা বেলা সে রাজেন্দ্র ধুপ ধুনা নিয়ে। আরতি করিল সেথা কান্দিয়ে কান্দিয়ে।। একদিন এক মিয়া তাড়াইয়া দেয়। তার পর সে রাজেন্দ্র সেখানে না যায়।। এই ভাবে কিছুদিন গত হয়ে যায়। উদ্দেশ্যে প্রণাম করি কান্দিয়া বেড়ায়।। মা সাধনা মা সাধনা বলিয়া কান্দিত। পাগলের মত প্রায় ঘুরিয়া বেড়াত।। আর দিন স্বপনেতে কহিল সাধনা। আমার জন্যেতে বাছা দুঃখ করিও না।। সমাধি হইতে মোরে তুলিয়া আনিবে। তোমার বাড়ীতে এনে যতনে রাখিবে।। পরদিন কহিলেন রমণীর কাছে। স্বপনেতে মা সাধনা আমাকে বলেছে।। সমাধি হইতে মোরে তুলিয়া আনিবে। আজি নিশি যাব তথা তুমি সঙ্গে যাবে।। তাই শুনি তার নারী স্বীকার করিল। নিশি যোগে দুই জনে তথায় চলিল।। কোদাল সঙ্গেতে আর ঝুড়িটি লইল। আধ আধ অন্ধকারে খুড়িতে লাগিল।। উরু সম গর্ত করে খুজিয়া না পায়। তাই দেখে তার নারী ক্রোধ ভরে কয়।। তোমার এ পাগলামী কেমনে বুঝাই। কেহ না দেখিতে চল ঘরে ফিরে যাই।। তারপর দুইজনে ঘরে ফিরে এল। ঘরে গিয়ে সে রাজেন্দ্র কান্দিতে লাগিল।। ঘরের পিছন থেকে কহিল সাধনা। শুন শুন বাছাধন আর কান্দিওনা।। যেখানে কাটিলে মাটি তাহার দক্ষিণে। বিঘাত প্রমাণ দুরে আছি সেই খানে।। এই কথা দুই জন যখনে শুনিল। কান্দিতে কান্দিতে তারা তথায় চলিল।। কোদাল ধরিয়া মাটি কাটিল যখন। সাধনার অস্থি গুলি পাইল তখন।। যত্ন করি অস্থি গুলি ঝুড়িতে করিয়া। মহানন্দে আসিলেন ঘরেতে ফিরিয়া।। বাড়ী পরে অস্থি গুলি সমাধি করিল। তারপর ঘর করি মাথাটি রাখিল।। আসন পাতিয়া মাথা রাখিল যতনে। সকাল সন্ধ্যায় পুজা করে এক মনে।। এখনও সেই মাথা আসনেতে রয়। শত শত মানুষেতে দেখিবারে যায়।। অধম বিনোদ বলে আর কিবা চাও । সাধনা তারক প্রীতে হরিগুণ গাও।। সূক্ষ্ম দেহে তারক হরি-গুরুচাঁদ বন্দি যুগল চরণ। আশ্চর্য্য ঘটনা এক করিব বর্ণন।। তারকচাঁদের গুণ কহন না যায়। স্মরণ করিলে হয় প্রেমের উদয়।। এমন সোনার ছবি জগতে আসিল। হরিনাম প্রচারিয়া নিজদেশে গেল।। সূক্ষ্মরূপে ঘুরিতেছে জগত ভরিয়া। ভক্তি করে ডাকে যেবা দেখেন আসিয়া।। তার কিছু তত্ত্ব কথা বলিব এখন। মন দিয়া শুন সবে করিব বর্ণন।। শ্রী উপেন্দ্র নামে ছিল পাল মহাশয়। রায়পুর বাড়ী ছিল শুন পরিচয়।। লোহাগড়া থানা মধ্যে সেই গ্রাম হয়। চৌদ্দশত ছয় সালে ঘটনা তথায়।। সরল স্বভাব নিয়ে উপেন্দ্র চলিত। মনে প্রাণে তারকেরে সে ভালবাসিত।। মনে মনে হরিনাম করিত সদায়। এই ভাবে চলিতেন পাল মহাশয়।। ছেলে মেয়ে ছিল তার সোনার সংসার। সংসারেতে অনটন নাহি ছিল তার।। এক মেয়ে বিয়ে দিল কুন্দশী গ্রামেতে। মাঝে মাঝে যাইতেন জামাই বাড়ীতে।। সরল সহজ মনে বেড়াইত ঘুরে। তারপর কি হইল বলিব সবারে।। একদিন তার ছেলে লোহাগড়া গেল। একটি নতুন ছাতা কিনিয়া আনিল।। একশত বিশ টাকা ছাতাটির মূল্য। ছাতাটিকে দেখে সবে আনন্দিত হলো।। একদিন সে উপেন্দ্র ছাতাটিকে নিয়ে। জামাই বাড়ীতে গেল আনন্দিত হয়ে।। কুন্দশী গ্রামেতে ছিল জামাতার বাড়ী। আনন্দেতে পথে চলে বলে হরি হরি।। যখনেতে জয়পুর গ্রাম মধ্যে যায়। তারকের ছবিখানি জাগিল হৃদয়।। তারকের বাড়ী পার্শ্ব দিয়া সেই পথ। সেই পথে সে উপেন্দ্র করে যাতায়াত।। হাটিতে হাটিতে গেল তারকের বাড়ী। মন্দিরে প্রণাম করে বলে হরি হরি।। তারপর চলিলেন কুন্দশী গ্রামেতে। আনন্দে উদয় হল জামাই বাড়ীতে।। তথায় মধ্যাহ্ন ভোজ করি সমাপন। অল্প বেলা করিলেন গৃহেতে গমন।। হাটিতে হাটিতে যবে জয়পুর গেল। তারকের মন্দিরেতে প্রণাম করিল।। ছাতাটাকে তথা রেখে প্রণাম করিয়া। পুনরায় করে যাত্রা করে ছাতা নিয়া।। হাটিতে হাটিতে গেল কলাগাছি গ্রামে। এমন সময় এল অন্ধকার নেমে।। জলের পিপাসা হল এমন সময়। রাস্তার পাশেতে এক কল দেখা যায়।। রাস্তার পাশেতে সেই ছাতাটিকে রেখে। টিউবলে জয় খায় মনের পুলকে।। জল খেয়ে সে উপেন্দ্র গৃহ পানে ধায়। মনের ভুলে ছাতাটিকে রাখিয়া তথায়।। বাড়ী গিয়ে সে উপেন্দ্র হাত মুখ ধুয়ে। গল্প কথা কহিলেন নাতি পুতি নিয়ে।। তারপর রাত্রি বেলা ভোজন করিল। হেন কালে তার ছেলে কহিতে লাগিল।। ছাতা নিয়ে গেলে তুমি কুন্দশী গায়। ছাতাটিকে দেখিনাত রাখিলে কোথায়।। তাই শুনে সে উপেন্দ্র ভাবিল হৃদয়। ঘরে গিয়ে খুঁজে দেখে কোথাও না পায়।। মনে মনে সে উপেন্দ্র ভাবিয়া না পায়। ছাতা বুঝি রাখিয়াছি জয়পুর গায়।। যখনেতে করি আমি মন্দিরে প্রণাম। ছাতাটিকে তথা রেখে গৃহে আসিলাম।। তাই ভেবে সে উপেন্দ্র কান্দিতে লাগিল। কেন্দে কেন্দে তারকের কাছে নিবেদিল।। তোমার মন্দিরে বাবা ছাতা রেখে আসি। ছাতাটি হারিয়ে গেলে গলে দিব রসি।। এই ভাবে কেন্দে কেন্দে করিল শয়ন। গভীর নিদ্রায় সে যে হল নিমগন।। প্রভাত হইল নিশি আধ অন্ধকারে। কেহনা জাগিল সবে আছে ঘুম ঘোরে।। তারক আসিয়া ডাকে দরজার ঠাই। শুন শুন ও উপেন্দ্র তোমাকে জানাই।। মোরে দোষী করে তুমি মরিতে চাইলে। সেই জন্যে দু’টি কথা আমি যাই বলে।। ছাতা রাখিয়াছ তুমি কলা গাছি গাঁয়। ভুল করে চলে এলে রাখিয়া তথায়।। সারানিশি তথা আমি প্রহরি হইয়া। ছাতাটিকে রক্ষা করি সেখানে বসিয়া।। এখন প্রভাত হলো শুন বাছাধন। ছাতাটিকে নিয়ে এস করিয়া যতন।। তাই শুনে সে উপেন্দ্র অতি ব্যস্ত হয়ে। বাহিরে আসিল তিনি দরজা খুলিয়ে।। বাহিরে আসিয়া দেখে আর কেহ নাই। কোথায় লুকাল মোর তারক গোঁসাই।। কান্দিতে কান্দিতে সে যে কালাগাছি গেল। সেই খানে সেই ছাতা দেখিতে পাইল।। ছাতাটিকে বুকে ধরে গড়াগড়ি যায়। তারক তারক বলে কান্দিয়া ভাষায়।। চারিদিকে হতে সবে আসিল তথায়। শুনিয়া সকল কথা কান্দিয়া ভাষায়।। কান্দিয়া বেনোদ বলে বেলা বেশী নাই। তারক চাঁদের প্রীতে হরি বল ভাই।। হরিচাঁদের নামের তরী হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ। আশ্চর্য্য ঘটনা এক করিব বর্ণন।। তাহার গুণের কথা কি লিখি কলমে। বিনা বায় নৌকা চলে হরিচাঁদ নামে।। অন্ধজনে চক্ষু পায় কালা কানে শোনে। মহাব্যাধি মুক্তি পায় তাহার স্মরনে।। তাহার নামের গুণে শমন পালায়। অপুত্রকে পুত্র পায় তাহার কৃপায়।। তেরশ ঊননব্বই সালে বারুণীতে। দলে দলে হরি বোলা আসিল ধামেতে।। বারুণীর স্নান মেলা করি সমাপন। যার যার দেশে সবে করিল গমন।। সে বৎসর দুর্যোগ হল অতিশয়। ঝড় বৃষ্টি অনুক্ষণ বহিত সদায়।। বোলতলী খোয়াঘাটে মতুয়ার গণ। পার হইতেছে সবে আনন্দিত মন।। পুবন বাতাস বহে অতি ঘোরতর। হরি হরি বলে সবে হইতেছে পার।। পশ্চিম কুলেতে এক নৌকা খানি ছিল। হেন কালে এক দল তথায় আসিল।। বরিশাল জেলা হতে সে দল আসিল। বহু লোক দলে তারা নৌকায় উঠিল।। নৌকার বোঝাই দেখে মাঝি ডেকে কয়। এত লোক নিয়ে হবে পার করা দায়।। একেত বাতাস ভারি ভীষণ তুফান। মাঝ পথে ডুবে যাবে এই তরী খান।। কিছু লোক নেমে গিয়ে কুলেতে দাঁড়াও। পুনরায় মোর নায় পার হয়ে যাও।। নৌকার মাঝির কথা কেহ ত শোনে না। নৌকা হতে কেহ আর কুলেতে নামে না।। তাই দেখে মাঝি বেটা দাড় বৈঠা খুলে। পারিব না পারে যেতে আসিলেন কুলে।। ডেকে বলে মাঝি বেটা মোর কথা লও। পার যদি হরি নামে পার হয়ে যাও।। তাই শুনে দলপতি হরিধ্বনি দিয়া। তাহাদের সকলেরে কহিছে ডাকিয়া।। শুনিয়াছি হরি নামে পারেতে ঠেকে না। হরিনামে ডংঙ্কা মার বিপদ হবে না।। তাই শুনে সবে মিলে হরিধ্বনি দিল। যত ছিল জয় ডঙ্কা বাজিয়া উঠিল।। দলপতি মনু সাধু আগা নায় গিয়া। হরি নাম করিতেছে কান্দিয়া কান্দিয়া।। বাজনার তালে তালে নৌকা খানি চলে। স্বচক্ষে দেখিল সবে থাকি দুই কুলে।। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে হিন্দু মুসলমান। দুই কুলে থাকি করে হরি গুণগান।। ছুটিল প্রেমের বন্যা উভয়ে কিনারে। হরি হরি বলে সবে ভাসে আখি নীরে।। উজানেতে নৌকা চলে দাঁড়ি মাঝি নাই। তাই দেখে দুই কুলে কান্দিছে সবাই।। নৌকার ভিতরে যত হরি বোলা ছিল। হরি হরি বলে সবে নাচিতে লাগিল।। নাচিতে নাচিতে তরী বেগে চলিতেছে। মনে হয় তরীখানি জীবন পেয়েছে।। হরি নামে শীলা ভাসে অগাধ সলিলে। আজ সেই হরি নামে এই তরী চলে।। হরি বলে কেহ কেহ ঝাঁপ দিল জলে। নৌকাখানি ধরিবারে সাতারিয়া চলে।। এই ভাবে তরীখানি কুলেতে ভিড়িল। শত শত হরিভক্ত আসিয়া মিলিল।। দলপতি মনু সাধু তাহাকে ধরিয়া। নাচিতে লাগিল সবে স্কন্ধেতে করিয়া।। ধরাধরি করি সবে বাজারে চলিল। বাজারেতে গিয়ে সবে কীর্তনে মাতিল।। হরিনামে মহাশব্দ উঠিল গগনে। হরি নামে মাতোয়ারা পড়ে ধরাসনে।। কেহ কেহ কেন্দে কেন্দে গড়াগড়ি যায়। প্রেমের তরঙ্গে সবে ভাসিয়ে বেড়ায়।। কেহ কেহ নাচিতেছে দুই বাহু তুলি। কেহ হরি হরি বলে গায় মাখে ধুলি।। কেহ কেহ কেন্দে কেন্দে হল অচেতন। ভাষা দিয়ে কি লিখিব আমি অভাজন।। ক্ষণেক চেতনা পেয়ে সকলে মিলিয়া। চাউল ডাউল আনে যোগাড় করিয়া।। ভক্তি ভাবে সবে কিলে করিল রন্ধন। মতুয়াগণেরে সবে করাল ভোজন।। এই ভাবে সাত দিন মহানন্দ হয়। যে দেখেছে তার মনে সে ভাব উদয়।। হরি হতে নাম বড় ব্যাক্ত এ জগতে। বোলতলী খেয়া ঘাটে দেখিনু চক্ষেতে।। তাই বলি ভাই সব আর কিবা চাও। হরিনামে তরী করে ভব পারে যাও।। অধম বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে। হরিচাঁদ ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।। তাই বলি ভাই সব বেলা বেশী নাই। হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।। ভায়াবহ বন্যা চৌদ্দশত সাত সালে দুরন্ত এ বন্যা। ভয়ংকরী রূপে এল পাহাড়ীয়া কন্যা।। উন্মাদিনী সম ধায় কল কল ধনী। ত্রাসিত মানব কুল গ্রাসিল মেদিনী।। উন্মত্ত যৌবন লয়ে ফুলাইয়া বুক। ভাসাইয়া জন প্রাণী দেখিছে কৌতুক।। দয়া নাই মায়া নাই পাষাণীর মেয়ে। ধ্বংস করিবারে এল নদী খাল বেয়ে।। গ্রাসিল ক্ষেতের শস্য আর বাড়ী ঘর। সলিল সমাধি হলো আর কত নর।। চারিদিকে হাহাকার কেন্দে ছাড়ে হাই। বাঁচিবার ভরসায় বৃক্ষে নিল ঠাই।। সে খানেও বাঁচিল না বিধির লিখন। বিষধর সর্প এসে করিল দংশন।। গো মহিষ ম’ল কত কে করে গণনা। বন্য পশু ম’ল কত সাধ্য নাই জানা।। এই ভাবে কত জন হারাল জীবন। ভাষা দিয়ে কি লিখিব আমি অভাজন।। কলার ভেলায় কেহ ভাসিয়ে বেড়ায়। কি করিবে কোথা যাবে ভাবিয়া না পায়।। কত শিশু জল স্রোতে ভাসিয়া বেড়ায়। অকালেতে ম’ল তারা কি লিখি ভাষায়।। শিশু ছেলে লয়ে কোলে কত নারী নর। অতি কষ্টে ওঠে গিয়ে ছাদের উপর।। কেহ কেহ দোতলায় নিয়াছে আশ্রয়। মাচা করে আছে কত বাঁচিবার দায়।। নাদায় ভরিয়া শিশু ছেড়ে দেয় জলে। ভাসিতে ভাসিতে যায় কোন দেশে চলে।। ঘরের চালেতে বসে বিড়াল কুকুর। অনাহারে কান্দিতেছে মিলাইয়া সুর।। মৃত প্রাণী ভেসে যায় হংসের আকার। এদৃশ্য যায় না দেখা লিখিব কি আর।। স্বামী হারা বিরহিনী কান্দিয়া বেড়ায়। নারী হারা নর কত করে হায় হায়।। সর্বস্য হারায়ে কেহ কেদে ছাড়ে হাই। কি করিবে কোথা যাবে কোন ঠাই নাই।। দিনাজপুর মালদা ঐ মুর্শিদাবাদ। ভয়াবহ জল রাশি ঘটা’ল প্রমাদ।। নদীয়ার জেলা সহ আর বর্ধমান। উত্তর চব্বিশ পরগণা ভাসমান।। বাকুড়া হুগলী আর বীরভূম সহ। এই কয় জেলা হল বন্যা ভায়বহ।। দুরান্ত রাক্ষসী বন্যা কোথা হতে এল। মানুষের সব কিছু কেড়ে লয়ে গেল।। বয়সে প্রাচীন দেশে আছে যারা যারা। এতবড় বন্যা কেহ দেখে নাই তারা।। এ দীন বিনোদ বলে ঈশ্বরের লীলা। ভাঙ্গা গড়া যত কিছু তার সব খেলা।। সমাপ্ত