শ্রীশ্রী অশ্বিনী চরিত্র সুধা
******হরিচাঁদ বন্দনা******
নম
নম
হরিচাঁন্দ পতিত
পাবন।
তব
শ্রীচরণে মোর
থাকে
যেন
মন।।
সাধনা
না
জানি
প্রভু
ভজন
না
জানি।
নিজ
গুনে
দাও
তব
চরণ
দুখানি।।
তুমি
হরি
গুণনিধি জগতের
সার।
এ
ভব
সাগর
হতে
কর
মোরে
পার।।
তোমার
গুণের
সীমা
বর্ণিতে কি
পারি।
গুণের
অতীত
তুমি
দয়াল
শ্রীহরি।।
তোমার
ইসারাতে এ
জগত
চলে।
তোমার
মায়াতে প্রভু
এ
জগত
ভোলে।।
সত্য
যুগে
ছিলে
তুমি
নাম
রূপ
ধরি।
ত্রেতা যুগে
রাম
রূপে
জন্মিলেন হরি।।
দ্বাপর যুগেতে প্রভু
কৃষ্ণ
অবতার।
কলিতে
গৌরাঙ্গ রূপে
হইল
প্রচার।।
তারপর
ওড়াকান্দি হলে
অবতার।
ঐ
চরণে
কোটি
কোটি
করি
নমস্কার।।
নম
নম
শান্তি মাতা
জগত
জননী।
হরিচাঁন্দ প্রাণ
প্রিয়া লোচন
নন্দিনী।।
চরণ
যুগলে
মাগো
করি
নিবেদন।
দয়া
করে
অধমেরে দাও
শ্রীচরণ।।
নম
নম
গুরুচাঁদ শ্রীহরি নন্দন।
করো
জোড়ে
বন্দি
তব
যুগল
চরণ।।
হরিনাম প্রচারিতে হইলে
প্রকাশ।
অধমেরে করপ্রভু শ্রীচরণে দাস।।
নমঃ
নমঃ
যশমন্ত ঠাকুরের পিতা।
নমঃ
নমঃ
অন্নপূন্না ঠাকুরের মাতা।।
নমঃ
নমঃ
কৃষ্ণদাস প্রভু
জ্যেষ্ঠ ভাই।
চরণেতে কোটি
কোটি
প্রণাম জানাই।।
নমঃ
শ্রী
বৈষ্ণব দাস
অংশ
অবতার।
নমঃ
নমঃ
গৌরি
দাস
সহিমা
অপার।।
নমঃ
শ্রী
স্বরূপ দাস
সবার
একনিষ্ঠ।
ঠাকুর
চরণে
যার
ভক্তি
একনিষ্ঠ।।
নমঃ
নমঃ
শ্রীসুধন্য ধীর
অবতার।
নমঃ
নমঃ
শ্রীপতিচাঁন্দ তাহার
কোঙর।।
নমঃ
শ্রী
প্রমথচাঁন্দ তুমি
গুণমনী।
নমঃ
নমঃ
বীনাপানি মাতা
ঠাকুরানী।।
নমঃ
নমঃ
মঞ্জুলীকা মাতা
ঠাকুরানী।
করোপুটে বন্দি
আমি
চরণ
দুখানি।।
নমঃ
নমঃ
অংশু
পতি
নমঃ
শচিপতি।
নম
শ্রীহিমাংশু পতি
পদে
করি
স্ততি।।
ঠাকুর
হইতে
এল
ঠাকুরের অংশ।
করো
জোড়ে
বন্দি
আমি
ঠাকুরর বংশ।।
অধম
বিনোধ
বলে
দিতে
নারী
সীমা।
কৃপা
করে
অধমেরে করে
দিও
ক্ষমা।।
*******ভক্তগন বন্দনা*******
নম নম হীরামন ভক্ত চুড়ামনী।
নিজগুনে দাও তব চরণ দুখানী।।
নম শ্রীগোলকচন্দ্র পাগোল গোসাই।
চরনেতে কোটি কোটি প্রণাম জানাই।
নম নম শ্রীলোচন বড় দয়া ময়।
দয়া করে অধমেরে রাখ রাঙ্গা পায়।।
নম নম মৃত্যুঞ্জয় সাধু শিরমনী।
নম নম মহানন্দ প্রেম রসধনী।।
নম শ্রীতারক চন্দ্র কবি চূড়ামনী।
দন্তে তৃণ ধরী বন্দী চরণ দুখানী।।
তোমার কৃপাতে পাই অমূল্য রতণ।
লীলামৃত গ্রন্থখানী শুধার মতন।।
নমঃ নমঃ দশরথ পদ্মবিলারাশী।
ঠাকুরের নামে প্রেমে হইল উদাশি।।
নমঃ নমঃ শ্রী অশ্বিনী প্রেমের মুরতী।
যাহার কৃপাতে পাই হরিচাঁদ গীতি।।
নমঃ নমঃ হরিপাল মহিমা প্রচুর।
গহন বাদার মধ্যে দেখিল ঠাকুর।।
নম শ্রীগোপাল সাধু কি মধুপাইয়া।
দক্ষিণ দেশে মাতাল হরিনাম দিয়া।।
নম নাটু নম ব্রজ নম বিশ্বনাথ।
দিবা নিশি থাকিতেন ঠাকুরের সাথ।।
উদ্দেশ্য বন্দিনু আমি যত ভক্ত গণে।
অগনিত ভক্ত বৃন্দ আছে যে খানে।।
অধম বিনোদ বলে ভক্ত গনে বলি।
কৃপা করে অধমেরে দিও পদ ধুলী।।
*******অশ্বিনীর জন্ম
কথা*******
গঙ্গাচন্না বাস করে, রাজ চন্দ্র নাম।
পোদ্দার বংশেতে জন্ম অতি গুণ ধাম।।
সরল স্বভাব নিয় করিত বসত।
তার হোলো তিন পুত্র সকলেই সত।।
জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিল তার শ্রীকার্তিক নাম।
মধ্যম গনেশ চন্দ্র কনিষ্ঠ শ্রীদাম।।
কার্তিকের সদা ছিল বৈষ্ণব আচার।
বৈরাগী উপাধী পরে হইল তাহার।।
মাসে মাসে করাইত বৈজ্ঞব ভোজন।
তার বাড়ী আসে কত সাধু মহাজন।।
হরিচাঁন্দ ঠাকুরের মতুয়ার দল।
সেই গ্রামে আসে কত বলে হরি বল।।
একদিন শ্রীগোলোক অাসিল তথায়।
মতুয়ার গণ লয়ে হরি গুণ গায়।।
পাগলের ভাব দেখে কার্তিক বৈরাগী।
পাগলের পদে পড়ে হল অনুরাগী।।
সেই হতে গুরু বলে করিল স্বীকার।
মন প্রাণ সপে দিয়ে হল নিব্বিকার।।
রাই চরণ অক্রুর মদন মোহন।
গোস্বামী চরণে করে আত্ম সমর্পন।।
গঙ্গার্চন্না গ্রামবাসি করেকত লোক।
পাগলেরে পেয়ে সবে হইল পুলক।।
সেই হতে গোস্বামীজী করে যাতায়াত।
ভক্ত বৃন্দ থাকে কত পাগলের সাত।।
কার্তিক বৈরাগী যবে বিবাহ করিল।
ক্রমে ক্রমে নয় বর্ষ গত হয়ে গেল।।
অম্বিকা নামেতে হয় কার্তিকের নারী।
পুত্র কন্যা না জন্মিল মনে দুঃখ ভারী।।
পাগলেরে কাছে সবে জানাই তাই।
কোন কিছু বলে নাক পাগোল গোসাই।।
একদিন দৈব যোগে কার্তিকের ঘরে।
মতুয়ার গান লয়ে হরি নাম করে।।
মহা ভাব উত্থলিল প্রেমের তরঙ্গ।
কান্দিতে কান্দিতে সেই কার্তিকের নারী।।
পাগোলের পদে পড়ে যায় গড়া গড়ি।
অমনী পাগল চন্দ্র ধরিয়া তুলিল।
মামা বলিয়া পাগোল ডাকতে লাগিল।।
মা-মা বলিয়া পাগোল স্তন পান করে।
বলে মাগো ছেলে হবে তোমার উদরে।।
হরি ভক্ত হবে সে যে বলিলাম বাণী।
নাম করনেতে নাম রাখিস অশ্বিনী।।
পাগোলের বরে মাতা গর্ভীনী হইল।
দশ মাস দশ দিনে প্রসব করিল।।
বার শত চুরাআশি সালে বুধবার।
কার্তিক মাসেতে জন্ম হইল তাহার।।
ব্রহ্ম মুহুর্তের কালে পূর্ণিমা যে তিথি।
পুত্র কোলে পেয়ে মাতা আনন্দিত অতি।।
আশে পাশে যত লোক শুনিতে পাইল।
হরি বলে সবে মিলে দেখিতে আসিল।।
উলুধ্বনী জয়ধ্বনী করে সবে মিলে।
দেশ বাসী সকলেই হরি হরি বলে।।
অশ্বিনীর জন্মক্ষণ হেন জ্ঞান হয়।
আকাশে বাতাসে যেন হরগুন গায়।।
অশ্বিনীর জন্মকথা শুনে যেই জন।
ভক্তির উদর হবে শুদ্ধ হবে মন।।
এদিন বিনোদ বলে পাচালীর ছন্দে।
হরিচাঁন্দ ছবি খানি হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ভাইসব আর কিবা চাও।
অশ্বিনীর প্রীতে সবে হরিগুণ গাও।।
****** অশ্বিনীর বাল্য জীবন*******
গোলক চাঁদের বরে রত্ন জনমিল।
দিনে দিনে মাতৃ কোলে বাড়িতে লাগিল।।
অশ্বিনীর মাতা পিতা আনন্দ হৃদয়।
মহা রত্ম কোলে করি হরি গুন গায়।।
কাত্তিকের পুত্র দেখে আনন্দ হৃদয়।
পাগোলের গুন গান গাহিয়া বেড়ায়।।
মাতৃ স্নেহে আশ্বিনী বাড়িতে লাগিল।
বিধাতার বিধি যাহা কে খান্ডাবে বল।।
দুই বর্ষ ছয়মাস বয়স যখন।
তার মাতা পরলোকে করিল গমন।।
শিশু বেলা যার মাতা পরলোকে যায়।
তার দুঃখ সারেনাকো লোকে তাই কয়।।
মাতৃ হারা শিশু সদা কান্দিয়া বেড়ায়।
তার পিতা কোলে করি করে হায় হায়।।
অশ্বিনীর পিসিমাতা দেখিয়া এ দৃশ্য।
তাহাকে পালিল শেষে মনে হয়ে হর্ষ।।
পিসিমার যত্ন পেয়ে বাড়িতে লাগিল।
তার পর সে কাত্তিক বিবাহ করিল।।
অশ্বিনীর বিমাতাসে নাম স্বরুপিনী।
প্রাণ দিয়ে অশ্বিনীকে ভালবাসে তিনি।।
মা-মা বলিয়া যখন ডাকিত অশ্বিনী।
ছুটেে এসে কোলে নিত হয়ে পাগলিনী।।
বাৎসল্যতে তবপুর তাহার হৃদয়।
পাড়া প্রতিবেশী সবে মানিল বিষ্ময়।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল।
ক্রমে ক্রমে পঞ্চবর্ষ বয়স হইল।।
একদিন তার পিতা বাড়িতে না ছিল।
পিসিমাতা বিমাতাও কার্য্যান্তরে গেল।।
একা একা বসে আছে ঘরের ভীতর।
মা বলিয়া কেন্দে ওঠে তাহার অন্তর।।
জলে ভরা আখি দুটি হাটিতে হাটিতে।
উদয় হইল গিয়ে সেবেলে ঘাটেতে।।
মামা বলিয়া শেষে কান্দিতে লাগিল।
কান্না শুনে গঙ্গা দেবী ভাসিয়া উঠিল।।
মাতৃ মূর্তি ধরি দেবী পুত্র নিল কোলে।
হরি ভক্ত কোলে করি ভাসে আখি জলে।।
শোন তবে ওরে পুত্র তোরে আমি বলি।
তোর মুখে ভাল শুনি হরি নাম বুলি।।
মায়ের কতার বানী শুনিয়া অশ্বিনী।
প্রাণ ভরে হরি নাম করেন তখনি।।
হরিভক্ত মুখে শুনী হরি নাম ধনী।
নয়ন জলেতে ভাসে মাতা সুরো ধনী।।
অলক্ষেতে বসে আছে ভক্ত কোলে করি।
হরিনাম শুনিতেছে সারা দিন ভরি।।
এদিকেতে বাড়ী শুদ্ধ খুজিতে লাগিল।
অশ্বিনীকে নাহি পেয়ে প্রাণ উড়ে গেল।।
অশ্বিনীর পিসিমা সে কান্দিয়া ভাষায়।
বিমাতা সে কেন্দে কেন্দে গড়াগড়ি যায়।।
গ্রামবাসী এসে সবে করে হায় হায়।
জলে পড়ে গেছে নাকি মনে এন লয়।।
তাই ভেবে সবে মিলে খুজিতে লাগিল।
খাল নাল বিল আর পুকুর খুজিল।।
কোথাও না পেয়ে সবে করে হায় হায়।
কি করিবে কোথা যাবে ভাবিয়া না পায়।।
বেলা গেল সন্ধ্যা হল এমন সময়।
বেলে ঘাট হতে সে হইল উদয়।।
দেখে তার পিসিতামা কোলেতে করিল।
কোথা ছিলি সোনা মোর কহিতে লাগিল।।
মাতৃহারা শিশু তুই মানিক রতন।
তোরে না দেখিলে বাপ বাঁচেনা জীবন।।
বল তুই কোথা ছিলি সত্য করি বল।
আমাদের কাছে তুই না করিস ছল।।
তাই শুনি অশ্বিনী লাগিল বলিতে।
একক্ষণ ছিনু আমি মায়ের কোলেতে।।
কোলে করে মাতা মোর কহিলেন বাণী।
কোলে বসে হরিনাম কর যাদুমনি।।
মার কোলে বসে আমি হরি গুণ গাই।
হরিনাম শুনে মাতা কেন্দে ছাড়ে হাই।।
তোমাদের কথা যেই পড়িল মনেতে।
ছুড়িয়া এসেছি আমি মার কোল হতে।।
শিশু মুখে এই কথা যখন শুনিল।
নয়নের জলে সবে ভাসিতে লাগিল।।
আশ্চর্য ঘটনা সবে করিয়া শ্রবণ।
বিস্ময় মানিয়া তাই ভাবে মনে মন।।
কেহ বলে এ ছেলের ভাগ্যে কিবা আছে।
মৃত আত্ম এসে তাই হরণ করেছে।।
কেহ ভাল কেহ মন্দ কলিতে লাগিল।
হেনকালে শ্রীকার্তিক কাড়িতে আসিল।।
শুনিয়া সকল কথা মানিল বিস্ময়।
পুত্র কোলে করে তিনি মুখ চুমু দেয়।।
পাগলের বরে এই পুত্র জনমিল।
তবে কেন এ ছেলের বিপদ ঘটিল।।
এর মাতা গিয়াছেন বৈকুন্ঠ ভুবন।
সে কেন করিবে কোলে অপূর্ব কথন।।
মনে হয় ছদ্মবেশে মাতা সুরাধনী।
রত্নকে পাইয়া কোলে করেছেন তিনি।।
রত্নকে করিও যত্ন সবারে জানাই।
যারে আনিছে ভবে, গোলোক গোসাই।।
এর ভবে কোনদিন বিপদ না হবে।
পাগলে আসিয়া তথা রক্ষা সে করিবে।।
এই কথা শুনে সবে সান্তনা পাইল।
এইভাবে কতদিন গত হয়ে গেল।।
তারপরে অশ্বিনীকে পাঠশালে দেয়।
লেখাপড়া করে আর গরিগুণ গায়।।
পাঠশালা শেষ করে আসিলেন বাড়ী।
মা-বাপের দুখ দেখে লেখা দিল ছাড়ি।।
নিজেদের গরুগুলি মাঠেতে চরায়।
মাঠে গিয়ে গরু রাখে হরি গুণ গায়।।
এইভাবে কতদিন গত হয়ে গেল।
সংসারের অনটন ক্রমেই বাড়িল।।
একাদশ বর্ষ যবে হইল তাহার।
তার পিতা মনে ভাবে কি করি এবার।।
বড় বেড়ে বাস করে সুধন্য পোদ্দার।
ধনধান্যে পরিপূর্ণ কত মান্য তার।
তার বাড়ী অশ্বিনীকে বেতন করিয়া।
বন্দোবস্ত করে তারে দিল পাঠাইয়া।।
প্রতি মাসে এক টাকা বন্দবস্ত হল।
গরু রাখিবারে রত্ন সেই বাড়ী গেল।।
এইভাবে সেই বাড়ী গরু চরাইত।
পরের ফসল কভু গরুতে না খেত।।
মাঠে গিয়ে গরু রাখে হরি গুণ গায়।
চারিদিকে হতে গরু আসিত তথায়।।
অশ্বিনীকে চটে আর মুখ পানে চায়।
ভাষাহীন পশুজাতি কি যেন কি কয়।।
তাই দেখে সে অশ্বিনী উঠিয়া দাঁড়ায়।
হস্ত বুলাইয়া গায় স্বান্তনা করিত।।
শুন শুন ওহে গরু আমার বচন।
পরের ফসল কভু খেওনা কখন।।
তাই শুনি গরুগুলি চরিয়া বেড়াত।
পরের ফসলে কভু নাহি মুখ দিত।।
তাই দেখে রাখালেরা আসিত তথায়।
অশ্বিনীকে ডেকে যেকে কহিত সবায়।।
কহভাই কার কাছে এ মন্ত্র শিখিলে।
গরুতে না মুখ দেয় পরের ফসলে।।
তাই শুনে তাহাদের বলিত অশ্বিনী।
তন্ত্র মন্ত্র ওইসব আমি নাহি জানি।।
আমি শুধু হরিনাম করিয়া বেড়াই।
হরিনাম ছাড়া কভু মানি নারে ভাই।।
তাই শুনে রাখালেরা মানিত বিস্ময়।
অশ্বিনীকে ভাল তারা বাসিত সবাই।।
গরু লয়ে সন্ধ্যাবেলা গৃহেতে আসিত।
যার যেইখানে স্থান সেখানে দাঁড়াইত।।
দুগ্ধবতী গাভীগুলি দোহন করিত।
পূর্বের চাইতে দুধ অনেক হইত।।
তাই দেখে গৃহ স্বামী সন্তষ্ট হইয়া।
অশ্বিনীকে কাছে নিয়ে কহিত কান্দিয়া।।
শুন শুন বাছাধন বলি যে তোমায়।
অবলা এই পশুজাতি কথা নাহি কয়।।
কোন গুণে এরা তোমা এত ভালবাসে।
তোমার কথায় এরা আখি জলে ভাসে।।
কহ বাছা এই ভাব বুঝিলে কেমনে।
মনে হয় পুর্বজন্মে এরা তোমা চেনে।।
তাই শুনি সে অশ্বিনী ভাবে মনে মনে।
মৌন হয়ে থাকে সদা ঝরে দুনয়েনে।।
তাই দেখে গ্রহস্বামী কিছু না বলিল।
ভোরবেলা সে অশ্বিনী বাড়ী চলে গেল।।
আর নাহি গেল সেই গ্রহস্থের বাড়ী।
তার পিতা কহিলেন দুটি হস্ত ধরি।।
কহ বাপ কি দুখেতে বাড়ী চলে এলে।
কথা নাহি কয় শুধু ভাসে আখি জলে।।
এই ভাবে বাল্যা কাল হয়ে গেল সায়।
মহাভাবে মহারত্ন হরি গুণ গায়।।
এদিন বিনোদ বলে পঁচালীর ছন্দে।
হরিচাঁদ ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ওরে মন বেলা বেশি নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরিব বল ভাই।।
****** অশ্বিনীর হরি
দর্শণ*******
হরিচাঁদ
প্রিয় ভক্ত মহানন্দ নাম।
নারিকেলবাড়ী জন্ম ভক্ত গুনধাম।।
গৌরাঙ্গ লীলায় ছিল নামে নিত্যানন্দ।
এ লীলায় হইলেন নামে মহানন্দ।।
একদিন চলিলেন গঙ্গাচন্না গায়।
হরিভক্ত শিরোমনি মদন মোহন।।
তাহার বাড়ীতে গিয়ে করে সংকীর্ত্তন।
পাগোল আসিল সেথা শুনিল কার্ত্তিক।।
আনন্দেতে আত্মহারা হইল বিদিক।
জলে ভরা আখি দুটি হাটিতে হাটিতে।।
ব্যস্ত হয়ে গেল তথা পাগোলে আনিতে।
কাদিয়া ধরিল গিয়া পাগোলের পায়।।
দয়া করে চল তুমি আমার আলয়।
পাগোল চলেছে তুমি সুস্থ কর মন।।
সেবা করাইবে হেথা মদন মোহন।।
মদনের বাড়ী হোল নাম সংকীর্ত্তন।
নামে প্রেমে মত্ত হল ভকতের গণ।।
মদনের ঘরে বসে ভোজন করিয়া।
কার্ত্তিকের বাড়ী এল ভক্তগন নিয়া।।
কার্ত্তিকের বাড়ী যবে হইল উদয়।
পরিবার সহ এসে চরণ ধোয়ায়।।
হুলুধ্বনী হরিধ্বনী করে সবে মিলে।
সবাকার অন্তরেতে আনন্দ উত্থলে।।
অশ্বিনী পড়িল এসে পাগোলের পায়।
নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।।
কার্ত্তিক আসিয়া বলে পাগোলের ঠাই।
শুন শুন ও পাগোল তোমাকে জানাই।।
আজি হতে অশ্বিনীকে তোমার চরণে।
সমর্পন করিলাম মঙ্গল কারণে।।
আজ হতে অশ্বিনীর গুরু তুমি হও।
আমার মনের বাঞ্ছা তুমি হে পুরাও।।
তাই শুনি মহানন্দ আনন্দ হৃদয়।
অশ্বিনীকে হস্ত ধরে কোলেতে বসায়।।
হরিনাম মহামন্ত্র করিলেন দান।
সেই হতে গুরুপদে সপিলেন প্রাণ।।
মহানন্দ বলে শুন ওহে বাছাধন।
হরিচাঁন্দ পদে যেন থাকে তব মন।।
হরি ধ্যান হরি জ্ঞান হরি সর্বসার।
মন প্রাণ সপে দিয়ে হও নির্বিকার।।
গুরুবাক্য শুনি রত্ন প্রণাম করিল।
ভক্তগনে বলে সবে হরি হরি বল।।
সেই হতে মহানন্দ গুরুরূপে হয়।
গুরু সেবা করে রত্ন আনন্দ হৃদয়।।
তাই দেখে ভক্তগণে করে সংকীর্ত্তন।
হরিনামে মাতোয়ারা ঝরে দুনয়ন।।
এইভাবে সারাদিন হরিনাম হয়।
বাহ্যজ্ঞান হারা সবে হরিগুন গয়।।
শতাধিক হরিভক্ত হইল গনণা।
মাত্র দুই সের চাউল হইল রান্না।।
কার্ত্তিক কাদিয়া বলে পাগোলের ঠাই।
কেমনে হইবে সেবা বলহে গোসাই।।
তাই শুনি মহানন্দ দ্রুতগতি ধায়।
অন্ন পাত্র কাছে গিয়ে হইল সদয়।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ।
অন্না পাত্রে হস্ত দিয়া কহিল তখন।।
এই অন্নে হয়ে যাবে নাহি কোন ভয়।
ভোজন করিল সবে আনন্দ হৃদয়।।
আশ্চর্য দেখিয়া সবে হরি হরি বলে।
কার্ত্তিক ঢলিয়া পড়ে ভক্ত পদতলে।।
তাহা দেখি মহানন্দ কার্ত্তিকে ধরিয়া।
কোলাকুলি করে শেষে প্রেমেতে মাতিয়া।।
হরিচাঁদ লীলা খেলা বড় চমৎকার।
হয় নাই হবে নাক এ বিশ্ব মাঝার।।
অল্প অন্ন অল্প ডাল ঠাকুর কৃপায়।
শতাধিক ভক্ত তাহা প্রাণ ভরি খায়।।
এহেন আশ্চর্য্য লীলা করি দরশন।
হরি বলে কাঁদে যত হরি ভক্তগন।।
কার্ত্তিক অমনি সেথা গড়াগড়ি যায়।
পরিবারসহ এসে পড়িল ধরায়।।
কিছু পরে প্রেমনিধি হইলেন ক্ষান্ত।
হরি গুনগানে সেথা নিশি হল হস্ত।।
ভোরবেলা এল ততা শ্রীরাইচরণ।
পাগোল চরণে এসে করে নিবেদন।।
আমার বাড়ীতে চল মতুয়ার সব।
এ দীনের গৃহে গিয়ে কর মহোৎসব।।
তাই শুনি মহানন্দ বাক্য সায়।
ভক্তগণ লয়ে সেথা হইল উদয়।।
হরিনামে মাতোয়ারা মতুয়ার গণ।
প্রেমে গদ গদ চিত্ত ঝরে দুনয়ন।।
অশ্বিনীকে ডেকে বলে সে রাইচরণ।
কদলির পত্র কেটে আন বাছাধন।।
তোমার উপর আমি দিলাম এ ভার।
কদলীর পাতা এনে দিওত সত্ত্বর।।
তাই শুনে সে অশ্বিনী করিল গমন।
কদলীর বনে গিয়ে দিল দরশন।।
মহাভাব উত্থলিল তাহার অন্তরে।
ছল ছল আখি দুটি হরিনাম করে।।
হরিচাঁদ হরিচাঁদ বলিয়া কাঁদিল।
প্রকান্ড শার্দুল এক তথায় আসিল।।
শার্দুলের গলা ধরি হরি হরি বলে।
ভক্তের পরশে ব্যাঘ্র ভাসে আখি জলে।।
আকস্মাৎ সেই ব্যাঘ্র হল অন্তর্ধান।
তাই দেখে সে অশ্বিনী হারাইল জ্ঞান।।
কিছু পরে মহারত্ন দেখিল চাহিয়া।
কতগুলি নারীমুর্ত্তি নাচিছে আসিয়া।।
ষোড়শী যুবতী তারা নৃত্য গীত গায়।
তাই দেখে সে অশ্বিনী পড়িল ধরায়।।
মা বলিয়া সম্বোধন করিল তখন।
ভক্তি গদ গদ চিত্ত ঝরে দুনয়ন।।
শুন শুন মাতাগন আমার বচন।
অধমের কৃপা করি দিও শ্রীচরণ।।
সাধন ভজন আমি কিছুই না জানি।
জলে ভরা আখি দুটি কহে স্তুতি বাণী।।
হরিভক্ত মুখে শুনি এহেন বচন।
অদৃশ্য হইয়া গেল সেই নারীগ।।।
হরি বলে কাঁদিতেছে ভক্ত শিরমনী।
আসিয়া দিলেন দেখা হরি গুনমনী।।
হরিচাঁদ বলে শুন হে বাছাধন।
ভক্তি পথে খাকে যেন সদা তব মন।।
হরি মুর্ত্তি দরশন করিয়া তখন।
কাঁদিয়া ধরায় পড়ে হল অচেতন।।
হরিচাঁন্দ লীলাখেলা কে বোঝে ধরায়।
অশ্বিনীকে দেখা দিয়া লুকাইয়া যায়।।
কিছু পরে সে অশ্বিনী চৈতন্য পাইয়া।
নয়নের জলেতে বক্ষ যেতেছে ভাসিয়া।।
তারপর সে অশ্বিনী কালাপাতা কাটি।
অতঃপর আসিলেন রাইচাদ বাটি।।
কাদিায় বিনোদ বলে বেলা বেশী নাই।
হরিচাঁন্দ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।
******গুরুচাঁন্দের বরলাভ*******
মহানন্দ পদাশ্রিত
হইল অশ্বিনী।
দিবানিশি মুখে তার হরি নাম ধ্বনি।।
হরিচাঁন্দ গুরুচাঁন্দ পোষা শুক পাখি।
মহাভাবে মাতোয়ারা ঝরে দুটি আখি।।
নির্জনে বসিয়া সদা হরি গুনা গায়।
প্রেমের পাথারে রত্ন ভাসিয়া বেড়ায়।।
একদিন তার পিতা সে ভাবে দেখিয়া।
বলিলেন মহানন্দ পাগোলকে গিয়া।।
শুন শুন ও পাগোল বলিযে তোমায়।
গঙ্গা চন্না চল তুমি আমার আলয়।।
অশ্বিনীর ভাব আমি বুঝিতে না পারি।
দিবা নিশি ফেরে সদাহরি নাম করি।।
সংসারের কর্ম্ম কিছু করিতে না চায়।
মহাভাবে থাকে সদা হরিগুন গায়।।
তাই শুনি মহানন্দ গঙ্গাচন্না এল।
অশ্বিনীর সেই ভাব দেখিতে পাইল।।
মহানন্দ বলে তুমি শুন বাছাধন।
কর্ম্মনাহি করে বাছা কিসের কারন।।
হাতে কাম মুখে নাম এযুগের ধর্ম্ম।
কি বুছিয়া ছেড়ে দিলে সংসারের কর্ম্ম।।
প্রসস্ত গার্হ্স্থধর্ম শিখাবার তরে।
হরিচাঁন্দ অবতীর্ণ এ বিশ্ব সংসারে।।
তাই শুনি সে অশ্বিনী চরণে পড়িল।
চরণ ধরিয়া শেষে কান্দিতে লাগিল।।
কেন্দে বলে ওগো বাবা চরণে জানাই।
অন্য কিছুতেই আমি শান্তি নাহি পাই।।
হরিনামে কি আনন্দ দিতে নারী সীমা।
প্রেমের তরঙ্গে ভাসি কি দিব উপমা।।
নামে প্রেমে মত্ত্ব হয়ে যেদিকে তাকাই।
হরিচাঁদ ছবিখানি দেখি বারে পাই।।
আকাশে বাতাসে আর লতায় পাতায়।
হরিচান্দ ছবিখানি ভাসিয়া বেড়ায়।।
তাই দেখে বাহ্যজ্ঞান হারাইয়া যায়।
কি করিতে কি না করি বুঝিয়ে না পাই।।
হেন বাক্য মহানন্দ শুনি কানেতে।
অশ্বিনীকে বুকে ধরি লাগিল কহিতে।।
শুন শুন বাছাধন বলি তব ঠাই।
তোর মত হরিভক্ত এ জগতে নাই।।
চলো তোরে লয়ে যাই ওড়াকান্দি বাড়ি।
শ্রীধামেতে বসে আছে পারের কান্ডারী।।
হরি হর এক আত্মা গুরু চাঁদ নামে।
দেখিতে পাই বা তাহা যাইয়া শ্রীধামে।।
হেরিলে সে গুরুচাঁদ যুগল চরণ।
তোমার মনের বাঞ্ছা হইবে পূরণ।।
তাই শুনি মহারত্ন বাক্যে দিল সায়।
গুরু সেবা করিলেন আনন্দ হৃদয়।।
তাই দেখে কার্ত্তিকের আনন্দ উত্থলে।
কেদে কেদে মহানন্দ পাগলকে বলে।।
আশ্বিনীকে যে দিনেতে তোমাকে দিয়েছি।
আমার জনম ধন্য সেদিন জেনেছি।।
বংশে যদি হরিভক্ত একজন হয়।
সে বংশ উজ্জ্বল হয় তাহার দ্বারায়।।
আমার ঔরস ধন্য তাতে জানা গেল।
গোলক চাঁদের বরে এ রত্ন জন্মিল।।
আজ হতে ঘরবাড়ী সকল তোমার।
যাহা ইচ্ছা তাহা কর কি আছে আামার।।
এই কথা যখনেতে কার্ত্তিক বলিল।
মহানন্দ ধরে তারে আলিঙ্গল দিল।।
কার্ত্তিকের বলে কয়ে পাগোল তখন।
অশ্বিনীকে সঙ্গে করে করিল গমন।।
হরিচাঁদ গুনগান করিতে করিতে।
ভাবে গদগদ চিত্ত চলেছেন পথে।।
পথে যেতে হরিভক্ত আসিয়া জুটিল।
পিছে পিছে তারা সবে চলিতে লাগিল।।
এইভাবে কত বাড়ী ঘুরিল পাগোল।
সবার মুখেতে শুধু হরি হরি বোল।।
এই বেশে সবে মিলে বলে হরি হরি।
সন্ধ্যাবেলা উপনীত নারিকেল বাড়ী।।
পাগোলের বাড়ী সবে কীর্ত্তনে মাতিল।
হরি বলে সে অশ্বিনী কাঁদিতে লাগিল।।
গুরুপাঠ মহাতীর্থ অশ্বিনী জানিয়া।
গড়াগড়ি যায় তথা মাটিতে পড়িয়া।।
হরিনামে মাতোয়ারা গড়াগড়ি যায়।
বাহ্যজ্ঞান হারাইল সমাধিয় প্রায়।।
তাই দেখ মহানন্দ অশ্বিনীকে ধরে।
কোলে করে রাখিলেন সমাদর করে।।
পদ্ম হস্ত বুলায়েছে অশ্বিনীর গায়।
গুরুর পরশ পেয়ে সুস্থ হয়ে রয়।।
ভোজনাদি করি সবে সে নিশি কাটায়।
প্রভাতে উঠিয়া সবে হরি গুন গায়।।
আচমন করি সবে পান্তা সেবা করি।
ওড়াকান্দি করে যাত্রা বলে হরি হরি।।
পথে যেতে হরিনাম করিতে করিতে।
উদয় হইল গিয়ে প্রভুর ধামেতে।।
দেখিয়া সে গুরুচাঁদ মহানন্দে কয়।
শুক পাখি ছানা তুমি পাইলে কোথায়।।
হরি বোলা পাখী এই শ্রীধামে আসিল।
আমার মনের বাঞ্ছা আজি পূর্ণ হোলো।।
তাই শুনি মহারত্ন চরণে পড়িল।
চরণে ধরিয়া সে যে কাঁদিতে লাগিল।।
কেঁদে বলে ওগো প্রভু করি নিবেদন।
অধমের কৃপা করি কর হে গ্রহণ।।
তব চরণেতে প্রভু এই ভিক্ষা চাই।
জনমে জনমে যেন ভুলিয়া না যাই।।
গুরুচাঁদ বলে বাছা শুন সমাচার।
তোর দ্বারা হরিনাম হইবে প্রচার।।
আমার পিতার গীতি তুইতো লিখিবি।
আমি তোরে বর দেই লিখিতে পারিবি।।
মহানন্দে ডাক দিয়া গুরুচাঁদ কয়।
শুন শুন মহানন্দ বলি যে, তোমায়।।
অশ্বিনীকে তুমি নিয়ে আসিলে হেথায়।
এবে এক কার্য্য কর বলি যে তোমায়।।
অশ্বিনীকে নিয়ে তুমি জয়পুর যাও।
তারকের কাছে দিয়ে কবিত্ব জাগাও।।
হরি বোলা পাখী এই জগতে আসিল।
জীবের কল্যাণ হেতু পাগোল আনিল।
গোলোক চাঁদের বরে আসিল ধরায়।
হরি লীলাগীতি হবে ইহার দয়ায়।।
তুমি যবে গুরুরূপে করিলে গ্রহণ।
তোমার কৃপায় হবে একার্য্য সাধন।।
মহানন্দ বলে প্রভু বলি তব ঠাই।
শ্রীমুখের বাক্য সত্য মনে ভাবি তাই।।
তুমি যারে কৃপা কর ওগো দয়াময়।
জীবনে মরনে তার নাহি কোন ভয়।।
পতিত তারিতে প্রভু আসিলে জগতে।
দয়াময় নাম তব হইল তাহাতে।।
গুরুচাঁদ চরণেতে প্রণাম করিয়া।
বিদায় হেইল শেষে আশ্বিনীকে নিয়া।।
জয়পুর যাব বলে করিল গমন।
অধম বিনোদ বলে হরি বল মন।।
******অশ্বিনীর
তারকের কৃপালাভ*******
অশ্বিনীকে
সঙ্গে করি সেই মহানন্দ।
চলেছেন মহাভাবে পরম আনন্দ।।
হরিচাঁদ গুরনকথা বলিতে বলিতে।
ভাবে গদ গদ চিত্ত চলেছেন পথে।।
জলে ভরা আখি দুটি প্রেমিক অশ্বিনী।
পিছনে পিছনে চলে জুড়ি দুই পানী।।
এইভাবে চলেছেন বলে হরি হরি।
সন্ধ্যাবেলা উপনীত তারকের বাড়ী।।
তারকের পদে সবে প্রণাম করিল।
হরি বলে রসরাজ আর্শীবাদ দিল।।
ভক্তিভাবে তারকের মহানন্দ কয়।
শুন শুন রসরাজ বলি যে তোমায়।।
অশ্বিনীকে নিয়ে আমি আসি তব ঠাই।
অশ্বিনীকে কর দয়া এই ভিক্ষা চাই।।
গুরুচাঁদ দিয়াছেন আদেশ করিয়া।
কবিগান শিক্ষা দাও ইহাকে রাখিয়া।।
তারক বলেছে আমি ভাবি মনে মনে।
অশ্বিনীকে কবিগান শিখাব যতনে।।
দয়াময় গুরুচাঁদ অন্তরে জানিল।
তোমা দ্বারা অশ্বিনীকে এখানে পাঠাল।।
গুরুচাঁদ আজ্ঞা আমি পালন করিব।
অশ্বিনীকে যত্ন করি কবি শিখাইব।।
সেই হতে অশ্বিনীকে তথায় রাখিয়া।
মহানন্দ আসিলেন দেশেতে চলিয়া।।
সেই হতে তারকের সঙ্গে সঙ্গে রয়।
তারকের গুরু মানি রহিল তথায়।।
চিন্তামনী দেবীকেই ডাকে মা বলিয়া।
তিনি তারে ভালবাসে পুত্র স্নেহ দিয়া।।
সকালে বিকালে রত্ন হরিগুণ গায়।
নয়ন জলেতে তার বক্ষ ভেসে যায়।।
সেই ভাব দেখি সবে আনন্দ হৃদয়।
সবাকার মনে হয় প্রেমের উদয়।।
মাঝে মাঝে রসরাজ কবিগান করে।
অশ্বিনীকে নিয়ে যায় কবির আসরে।।
যখনেতে হয় তথা কাব্য আলোচনা।
সেদিনের কথা সব হয়ে যায় জানা।।
সেই ভাবে কবিগান শিখিতে লাগিল।
ভাবের আবেশ তার ক্রমেই বাড়িল।।
এইভাবে মাঝে মধ্যে কবিগান গায়।
সংসারের কর্ম করে সকল সময়।।
প্রসস্থ গার্হস্থ ধর্ম আদর্শ দেখাতে।
হালের বলদ ছিল আবাদ করিতে।।
শম্ভু নামে এড়ে ছিল আর ছিল গাভী।
বকনা গরু ছিল যে নামেতে সুরভী।।
সেই গরু মাঝে মাঝে অশ্বিনী চরাত।
মাঠি গিয়ে সে অশ্বিনী হরিনাম নিত।।
হরিনাম করিবারে ঝরে দুটি আখি।
মনে হয় হরিচাঁদের পোষা শুকপাখী।।
হরি বলা পাখী সে যে জগতে আসিল।
শুকপাখী সবে তারা অনুগত হোলো।।
পতিত জমিতে গিয়ে গরু চরাইত।
প্রাণভরে গরু গুলি সে নাম শুনিত।।
হরিনাম শুনে তারা ছাড়ে আখিজল।
তাই দেখে সে অশ্বিনী বলে হরিবল।।
হরিনামে মাতোয়ারা ছাড়ে শুধু হাই।
চক্ষু জলে ভাসে বাহ্যজ্ঞান নাই।।
ভাষাহীন পশুজাতি হেন দৃশ্য দেখি।
একদৃষ্টে চেয়ে আছি না পালটে আখি।।
শুকপাখি উড়ে এসে গা পৃষ্টে পড়িত।
হরিনাম শুনে তারা আনন্দে নাচিত।।
অশ্বিনীর হরিনামে হেন জ্ঞান হয়।
আকাশে বাতাসে যেন হরি গুন গায়।।
কোকিল আসিয়া সেথ ধরে কুহু তান।
মনে হয় তারা করে হরি গুনগান।।
হরিভক্ত ভালবাসে পশু পাখিগণ।
তাই তারা কাছে এসে নিয়াছে স্মরণ।।
খনেক চৈতন্য পেয়ে নয়ন মেলিল।
গরুগুলি চেয়ে আছে দেখিতে পাইল।।
তাই দেখে সে অশ্বিনী উঠিয়া দাঁড়ায়।
গরুকে কহিছে ডেকে হস্ত দিয়া গায়।।
মাঝে গিয়ে ঘাস খাও মনের হরষে।
পেট ভরে গেলে আমি নিয়ে যাব শেষে।।
তাই শুনি গুরুগুলি মাঠ মধ্যে যায়।
মনের আনন্দে তারা চরিয়া বেড়ায়।।
তারপর সে অশ্বিনী বৃক্ষতলে যেত।
বসিয়া বসিয়া শুধু হরিনাম নিত।।
মনমত গরুগুলি ভোজন করিয়া।
অশ্বিনীর কাছে এসে দাঁড়ায় আসিয়া।।
অশ্বিনী বলিত মোরা চল বাড়ী যাই।
পথ বেয়ে গুরুগুলি চলিত সবাই।।
পিছনেতে চলে রত্ন বলে হরি হরি।
সন্ধ্যা অগ্রে উপনীত তারকের বাড়ী।।
যত্ন করি গরুগুলি গোয়ালে বাধিত।
হাত মুখ ধুয়ে সে যে গৃহেতে পশিত।।
তারকের কাছে গিয়া জুড়ি দুই হাত।
ছল ছল আখি দুটি করে প্রণিপাত।।
দুই হাতে পদ ধুলি লইত মাথায়।
নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।।
তাই দেখি রসরাজ বলিত বচন।
তোমার মনের বাঞ্ছা হইবে পূরণ।।
মায়ের চরণে গিয়ে প্রণাম করিত।
স্নেহ ভরে মাতা মোর তাহাকে কহিত।।
তুই মোর প্রাণাধিক ওহে বাছাধন।
মনের বাসনা তোর হইবে পূরণ।।
এইভাবে কতদিন গত হয়ে যায়।
হাতে কাম মুখে নাম করিত সদায়।।
এইভাবে কতি দিন গত হয়ে গেল।
মাঝে মধ্যে কবিগান শিখিতে লাগিল।।
একদিনি অশ্বিনীকে বলে রসরাজ।
এবে তুমি মাছে গিয়ে কর কৃষিকাজ।।
হালের বলদ লয়ে জমি চাষিবারে।
মাঝে মধ্যে চলে যাও বলি যে তোমারে।।
এইকথা বলা মাত্র তারক সুজন।
পশ্চিমপাড়ায় গেল করিতে ভ্রমন।।
গুরু বাক্য শুনি রত্ন ভাবে মনে মন।
কোন জমি চাষ করি নাহি নির্দ্ধারন।।
মনে মনে সে অশ্বিনী ভাবিতে লগিল।
বলদের কাছে গিয়ে কাতরে কহিল।।
শুন শুন গো দেবতা আমার বচন।
যেই জমি চাষ হবে করহে গমন।।
তোমরাত জান ভাল মোর জানা না।
যেই জমি চাষিবারে বলেছে গোসাই।।
তাই শুনি গরু দুটি গমন করিল।
পিছে পিছে সে অশ্বিনী চলিতে লাগিল।।
লাঙ্গল জোয়াল স্কান্ধে চলে পিছে পিছে।
যে জমিতে গিয়া গরু দাড়াইয়া আছে।।
তাই দেখে সে অশ্বিনী লাঙ্গল জুড়িল।
হরি বলে সেই জমি চষিতে লাগিল।।
জমি চাষ করে আর হরি গুণ গায়।
হরি নাম শুনে গরু দ্রুতগতি ধায়।।
দেখিতে দেখিতে জমি চাষ হয়ে গেল।
অমনি হালের গরু ছাড়াইয়া দিল।।
তাহাদের বলিলেন মাঠ মধ্যে যাও।
পতিত জমিতে গিয়ে চরিয়া বেড়াও।।
গরুগুলি ছেড়ে দিয়ে ভক্ত শিরমনী।
মাঠ পার্শ্বে বৃক্ষতলে চলিল অমনি।।
শ্রম করি বসে গিয়া বৃক্ষের ছায়ায়।
ঘার্মাক্ত দেহখানি সুশীতল হয়।।
গুন গুন হরিনাম করিতে করিতে।
শয়ন করিল শেষে বৃক্ষের ছায়াতে।।
নিদ্রার আবেশ হয়ে হোল অচেতন।
ঘুম ঘোরে হরিনাম করে উচ্চরণ।।
ভীষণ রৌদ্রের তাপ বৃক্ষ পাতা ফাঁকে।
সূর্যের কিরণ পড়ে হরিভক্ত মুখে।।
হরিভক্ত কষ্ট দেখে দয়াময় হরি।
অশ্বিনীকে ছাড়া দেয় স্বার্প মুর্ত্তি ধরি।।
দয়াময় হরি আজি ভক্তের লাগিয়া।
সর্পরূপে ছায়া দেয় ফণা বিস্তারিয়া।।
দেখরে জগতবাসী দেখরে চাহিয়া।
কিভাবে কি করে হরি ভক্তের লাগিয়া।।
এইভাবে সে অশ্বিনী বৃক্ষ তলে রয়।
মধ্যাহ্ন হইল গত হল অসময়।।
অসময় হলো দেখি তারক গোসাই।
অশ্বিনী আসেনা কেন মনে ভাবে তাই।।
মন বড় উচাটন কি করি উপায়।
অশ্বিনীকে খুজিবারে মাঠে মধ্যে যায়।।
মাঠে মধ্যে গিয়ে তিনি দেখিবারে পায়।
পতিত জমিতে গরু চরিয়া বেড়ায়।।
অশ্বিনীকে নাহি দেখি ভাবিতে লাগিল।
বৃক্ষতলে লক্ষ্য করে দেখিতে পাইল।।
কিছু দুর থেকে দেখে আশ্বর্য্য ঘটনা।
মস্তক উপরে আছে স্বর্পরাজ ফনা।।
এমন সাপের ফনা কভু দেখি নাই।
পরাণ ভরিয়া দেখে তারক গোসাই।।
ধীরে ধীরে শ্রীতারক নিকটেতে গেল।
অদৃশ্য হইয়া স্বর্প বাতাসে মিশিল।।
তাই দেখে তারকের ঝরে আখি জল।
আদ আদ ভাষা দিয়ে বলে হরেবল।।
ছুটে গিয়ে অশ্বিনীকে বুকেতে ধরিল।
মহাভাবে সে তারক কহিতে লাগিল।।
কত কষ্ট করি আছ হাল চাষ করি।
তাই তব মনে বাছা দুঃখ হল ভারী।।
কেন বাছা শুয়ে আছ গাছের ছায়ায়।
শ্রীঘ্র তুমি ঘরে চল বেলা বয়ে যায়।।
তাই শুনি সে অশ্বিনী চরণে পড়িল।
চরণ ধরিয়া সে যে কান্দিতে লাগিল।।
হাল চাষ করি আসি গরু ছেড়ে দিয়ে।
বৃক্ষতলে এসে আমি রহেছি ঘুমায়ে।।
বেলা বয়ে গেছে মোর হেলায় হেলায়।
অপরাধ ক্ষমা কর ধরি তব পায়।।
তারক বলেছে তোর অপরাধ কিরে।
তোর মত হরিভক্ত নাই এ সংসারে।।
ত্বরা করি চল বাছা গৃহেতে চলে যাই।
অন্য কথা দিয়ে তব আর কার্য্য নাই।।
তারকের বাক্য শুনি অশ্বিনী তখন।
গরু লয়ে করিলেন গৃহেতে গমন।।
সেই হতে ভাবিলেন কবি রসরাজ।
অশ্বিনীকে দিয়ে আর করিব না কাজ।।
কাদিয়া বিনোদ বলে বেলা বেশি নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।
******হরিভক্ত দরশনে গঙ্গার পাপ মোচন*******
এইভাবে শ্রী অশ্বিনী, জয়পুর থাকে তিনি
ভক্তি করি তারকের পায়।
কবিগান শিখিবারে, দলেতে দোয়ারী করে
মহাভাবে থাকিত সদায়।।
অশ্বিনীর কন্ঠ সুর, মধু হতে সুমধুর
আসরেতে করে কবিগান।
আসরেতে শ্রোতাবৃন্দ, শুনিয়া পরমানন্দ
হরিচাঁদ ভক্ত শিরমনী।
গান শুনি আনন্দিত, আসরের শ্রোতা যত
শ্রোতাগন কাহে একজন।
প্রেমরসে তনুখানি, হরিভক্ত শিরমনী
হরি বলে ঝরে দুনয়ন।
হরিচাঁদ রূপরসে, সদা আখি জলে ভাসে
হরিচাঁদে সপে মন প্রাণ।
যেদিকে ফেরায় আখি, হরিচাঁদ রূপ দেখি
অমনি হারায় বাহ্যজ্ঞান।।
সবে করে জয়ধ্বনী, শ্রীতারক তাহা শুনি
মস্তকেতে হস্ত দিয়া কয়।
শুন শুন বাছাধন, তুমি প্রেম মহাজন
হরি বলে আর্শীবাদ দেয়।
এইভাবে দেশে দেশে, কবিগান করি শেষে
জয়পুর গিয়ে সাঝে রয়।
হরিভক্ত শিরমনী, শ্রীতারক তাহা জানি
কর্ম করিবারে নাহি দেয়।।
বলে তুমি শুন সোনা, কোন কর্ম করিওনা
সদা কর হরি গুনগান।
হরিচাঁন্দ লীলাগীতি, লিখ তুমি শীঘ্রগতি
আশির্বাদ করিলাম দান।।
ওড়াকান্দি গুরুচাঁদ, করেছেন আশির্বাদ
আমি আর বাক্যে দিনু সায়।
তারকচাঁন্দের বানী, শুনিয়া সে অশ্বিনী
কাঁদিয়া ধরিল গিয়া পায়।।
ছল ছল আখি দুটি, কহিছেন কর পুটি
আমা দ্বারা সম্ভাব না হয়।
বিদ্যা বুদ্ধি মোটে নাই, কেমনে লিখিব তাই
বল গুরু করি কি উপায়।।
তারক কহিছে বানী, শুন শুন যাদুমিণী
হরিচাঁদ হৃদয় আসিয়া।
তোমা দিয়া লেখাইবে, উপলক্ষ তুমি হবে
ভাব তুমি কিসের লাগিয়া।।
গুরু মুখে এই বাণী, শুনি ভক্ত শিরমনী
কিছুদিন জয়পুরে রয়।
সদা হরিনাম করে, হরিনামে আখি ঝরে
প্রেমের তরঙ্গে ভেসে যায়।।
এইভাবে দিন গেল, কতদিন গত হল
শুন এক আশ্চির্য্য ঘটনা।
নব গঙ্গা নদিতীরে, অশ্বিনী বেড়ায় ঘুরে
হরিনাম কখন ভোলে না।।
নব গঙ্গা নদীকুলে, হিজলিকা বৃক্ষ দোলে
শাখাগুলি জলের উপর।
মহানন্দে বাহু তুলে, গঙ্গা মাকে পাব বলে
ঠিক যেন উপাসনা করে।।
সেই বৃক্ষ শাখা পরে, বসিয়া আনন্দ ভরে
প্রেমিক অশ্বিনী সদা রয়।
হরিচাঁদ পোষা পাখি, হরিনামে ঝরে আখি
প্রেমের তরঙ্গে ভেসে যায়।।
এক শাকে পদ দিয়ে ,অন্য শাখাতে বসিয়ে
আনন্দেতে হরি গুন গায়।
হরি হরি হরি বলে, ভেসেছে নয়ন জলে
সেই জল জলে ভেসে যায়।।
হরিনাম ধ্বনী শুনে, ভেসে ওঠে সুরোধনী
হরিভক্ত সঙ্গ পেতে চায়।।
বসিয়া মকর পৃষ্ঠে, চেয়ে আছে এক দৃষ্টে
নাম গুনে পরাণ জুড়ায়।।
ঝর ঝর আখি ঝরে, ধরে মাতা দুই করে
সর্ব পাপ হরণ আশায়।।
ভগীরথ যেদিনেতে, গঙ্গা আনে এ মহিতে
গঙ্গা জম্মে শ্রীহরির পায়।।
জন্মিয়া সে সুরধনী, ভগবানে বলে বানী
কেন প্রভু জন্মালে আমায়।
দয়াময় বলে বাণী, শুন মাতা সুরোধনী
শীঘ্র গতি যাহ মা ধরায়।।
পাপী তাপী উদ্ধারিতে, যাহ তুমি অবনীতে
ভগীরথ সঙ্গে তুমি যাও।
সাগরের বংশ যত, ব্রহ্ম পাশে ভস্মীভূত
আগে তুমি তাদের তারাও।।
আর যত পাপী হবে, তোমা যদি পরশিবে
তারা সবে মুক্ত হয়ে যাবে।।
গঙ্গা বলে দয়াময়, ধরি আমি তব পায়
মম পাপ কেমনে ঘুচিবে।।
শুনিয়া গঙ্গার বাণী, কহিলেন চক্রপাণী
শুন গঙ্গা বলি তব ঠাই।
আমা হতে নাম বড়, নাম হতে ভক্ত বড়
হরিভক্ত সঙ্গ করা চাই।।
মম ভক্ত দরশনে, মম ভক্ত পরশনে
সর্ব্ব পাপ মুক্ত হয়ে যাবে।
তাই আজি সুরোধনী, হরিনাম ধ্বনি শুনি
দরশনে পরাণ জুড়াবে।।
রোজ রোজ তথা আসি, গাছের ডালেতে বসি
এইভাবে হরিনাম করে।
গঙ্গা মা আনন্দ মনে, নিত্য আসি নাম শোনে
আনন্দে মকর লেজ নাড়ে।।
গ্রামবসী একজন, করি তাই দরশন
তারকের কাছে গিয়া কয়।
অশ্বিনীকে কর মানা, সে যেন গাছে যায় না
কবে যেন কুম্ভীরেতে খায়।।
নদীকুলে বৃক্ষডালে, বসে হরি হরি বলে
নয়নের জলে ভেসে যায়।
আমি দেখিলাম এসে, কুম্ভীর রয়েছে ভেসে
তাই আমি জানাই তোমায়।।
হেন কথা শুনি কানে, রসরাজ ভাবে মনে
কোন কিছু না পায় ভাবিয়া।
সাপে যারে ছায়া দেয়, তারে কি কুমীরে খায়
নিজ গিয়ে দেখিব আসিয়া।।
তাই ভাবি মনে মনে, থাকিয়া গোপনে স্থানে
চেয়ে চেয়ে দেখিবারে পায়।
অশ্বিনী বসিয়া ডালে, সদা হরি হরি বলে
নয়নের জলে ভাসে যায়।।
মা গঙ্গা মকর পরে, দুই হাতে উচু করে
ধরিতেছে নয়নের জল।
ধরিয়া নয়ন বারি, লইতেছে শিরপরি
আনন্দেতে বলি হরি বল।।
মনে ভাবে রসরাজ, কি যেন হইল আজ
গঙ্গা মাকে করে দরশন।
হেন দৃ্শ্য চোখে দেখি, পালটিতে নারে আখি
ঝর ঝর ঝরে দুনয়ন।
দেখিয়া গঙ্গার মুর্ত্তি, করে কত স্তবস্ততি
বলে মাগো রাখিও চরণে।
পাপী তাপী উদ্ধারিতে, আসিলেন অবনীতে
ধন্য আমি তব দরশনে।।
নিজ পাপ মুক্ত হতে, হরিভক্ত সঙ্গ নিতে
খেলা কর এখানে আসিয়ে।
ধন্য ধন্য শ্রী অশ্বিনী, হরি ভক্ত শিরমনী
ধন্য আমি তার গুরু হয়ে।।
এইভাবে স্তুতি করে, হরি বলে আখি ঝরে
কেঁন্দে কেঁন্দে পড়িল ধরায়।
তাই দেখে সে অশ্বিনী, হরিভক্ত শিরমনী
গুরু পদে কেঁন্দে কেঁন্দে কয়।।
আমি বড় অপরাধী, তুমি মোর গুণনিধি
চরণেতে ক্ষমা ভিক্ষা চাই।
তারক কহিছে বাণী, শুন শুন যাদুমণী
তোর কোন অপরাধ নাই।।
অশ্বিণীর হস্ত ধরে, চলিলেন ধীরে ধীরে
তখনি গৃহিতে চলে গেল।
কাঁন্দিয়া বিনোদ বলে, এ জনম গেল চলে
হরিভক্ত সঙ্গ নাহি হলো।।
******অশ্বিনীর কবি গাওয়ার আদেশ*******
একদিন শ্রীতারক গান গাহিবারে।
দল বল সহ গেল কালিয়া বাজারে।।
বিপক্ষের সরকার আনন্দ নামেতে।
দূর্গাপুর বাড়ী ছিল বিখ্যাত কবিতে।।
দৈবের কারণে তিনি আসিল না সেথা।
আসরেতে বসে আছে শত শত শ্রোতা।।
তাই জেনে বলিতেছে তারক গোসাই।
শুন বলি ও অশ্বিনী তোমাকে জানাই।।
তুমি আজি বিপক্ষের সরকার হও।
আমার সঙ্গেতে তুমি কবি গান গাও।।
তাই শুনে সে অশ্বিনী কেঁন্দে কেঁন্দে কয়।
আমা দ্বারা এই কাজ সম্ভব না হয়।।
তারক বলেছে বাছা শোন তোরে কই।
আশির্বাদ দিনু আমি তুই হবি জই।।
তাই শুনে সে অশ্বিনী আসরেতে গেল।
বিপক্ষের কবি সেজে গাহিতে লাগিল।।
অশ্বিনীর শুনে সবে কাব্য অলোচনা।
নিশ্চয় পুরান কবি করিল ধারনা।।
পাঁচালী করিয়া সাঙ্গ ধরে ধুয়া গান।
ধুয়া গানে হরে নিল শ্রোতাগণের প্রাণ।।
অশ্বিনীর কন্ঠ ধ্বনি অতি সুমধুর।
শ্রোতাগনে বলে সুরে মধুর মধুর।।
গান শুনে আত্মহারা কেহ কেহ কয়।
এতদিন এই কবি ছিল বা কোথায়।।
গানেতে হরিয়া নিল সবাকার প্রাণ।
গান শুনে কত জনে হারাইল জ্ঞান।।
কেহ কেহ সেই গানে আখি জলে ভাসে।
জয় জয় ধ্বনি ওঠে আকাশে বাতাসে।।
গান শুনে কেঁন্দে ওঠে তারকের মন।
আশির্বাদ দেয় তারে করি আলিঙ্গন।।
সে আসরে গান করে হইল বিদায়।
বিদায় হইল সবে আনন্দ হৃদয়।।
তাহা হতে চলিলেন চালনা গ্রামেতে।
কবিগান করিবেন সেই আসোরেতে।।
সেখানেতে করিলেন কাব্য আলোচনা।
অশ্বিনীর গুন গান কহে সর্ব্বজনা।।
তাই শুনে তারকের আনন্দ বাড়িল।
ধন্য ধন্য বলি তারে আশীর্বাদ দিল।।
সেই খানে গান শেষে বিদায় হইয়া।
জয়পুর চলিলেন অশ্বিনীকে নিয়া।।
অশ্বিনীকে বলিলেন তারক গোসাই।
শুন শুন রে অশ্বিনী তোমাকে জানাই।।
বাড়ী গিয়ে দল করি কবিগান গাও।
হরিচাঁদ লীলাগীতি তুমি লিখে দাও।।
হরিচাঁদ পোষা পাখি তুমি বাছাধন।
তোমার মনের চাঞ্ছা হইবে পুরন।।
তাই শুনি সে অশ্বিনী প্রণামিয়া পায়।
ছল ছল আখি দুটি কেঁন্দে কেঁন্দে কয়।।
আমি অতি মূঢ়মতি কোন গুন নাই।
কেমনে পারিব আমি তোমাকে জানাই।।
তারক বলেছে বাছা ভয় কি লাগিয়া।
গুরুচাঁদ দিয়াছেন আশীষ করিয়া।।
ভয় নাই চলি যাও কর কবিগান।
আমি আজি করিলাম আশির্বাদ দান।।
তাই শুনে প্রণামিল তারকের পায়।
ছল ছল আখি দুটি কেঁন্দে কেঁন্দে কয়।।
তোমার আদেশ আমি করিব পালন।
সূহ্মরূপে মম দেহে থাকিও তখন।।
চিন্তামনী পদে গিয়া প্রণাম করিয়া।
জলে ভরা আখি দুটি কহিছে কাঁন্দিয়া।।
এতদিন ছিনু মাগো তোমাদের ঠাই।
বিদায় করহ মাতা গঙ্গাচন্না যাই।।
চিন্তামনী বলিলেন শুন বাছাধন।
ভক্তিপথে থাকে যেন সদা তব মন।।
এই ভাবে বলে কয়ে করিল গমন।
গৃহে এসে সে অশ্বিনী ভাবে মনে মন।।
কবিগান করিবারে বলেছে গোসাই।
কেমনে করিব দল মনে ভাবে তাই।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ মনেতে ভাবিয়া।
দল করি কবিগান বেড়ায় গাহিয়া।।
তিন বর্ষ কবিগান গাহিলেন মাত্র।
আসরেতে গান গায় ঝরে দুটি নেত্র।।
মাঝে মাঝে আসরেতে সম্বিত হারায়।
কবিগান ছেড়ে দিয়ে হরি গুন গায়।।
হরিচাঁদ লীলা গান রচনা করিয়া।
ভাবের আবেশে সদা বেড়াত গাহিয়া।।
নিজের রচনা পদ নিজে সুরকার।
নিজে গেয়ে নিজে শোনে চোখে বহে ধার।।
এইভাবে কতদিন গত হয়ে গেল।
কাঁদিয়া বিনোদ বলে হরি হরি বল।।
******অশ্বিনীর সংসার জীবন*******
কবিগান ছেড়ে দিয়ে হরি গুণ গায়।
সংসারের অনটন কষ্টে দিন যায়।।
মা বাপের দুঃখ দেখে আনন্দ মনেতে।
মজুরী খাটিতে যায় পরের জমিতে।।
এইভাবে সংসারের চলিতে লাগিল।
হরি সংগীতের গান লিখিয়া চলিল।।
নিজের হাতের লেখা মোটে ভাল নয়।
পাঠশালে শিখেছিলেন বর্ণ পরিচয়।।
ভদ্রকান্ত নামে ছিল খুব-তাত ছেলে।
অশ্বিনীকে ডাকিতেন দাদা দাদা বলে।।
তাহার হাতের লেখা অতীব সুন্দর।
তারে দিয়ে লেখাইত পান্ডলীপি তার।।
এইভাবে কতদিন গত হয়ে গেল।
হরি লীলাগান সদা লিখিতে লাগিল।।
একদিন বলে তারে তার পিসিমাতা।
বিবাহ করিতে হবে শুন মোর কথা।।
পাড়া প্রতিবেশী সবে আত্মীয় স্বজন।
সকলের ইচ্ছা তুমি করহে পুরন।।
অশ্বিনী বলেছে আমি বিয়া না করিব।
বিবাহ করিলে আমি পাশ বব্ধ হব।
মায়াজাণে বন্দী হয়ে সংসারেতে রব।।
মধুমাখা হরিনাম ভুলিয়া যাইব।
তাই শুনি তার পিতা বলেছে বচন।।
সার কথা আমি তোমা বলিব এখন।
প্রশস্ত গার্হস্থ ধর্ম্ম শিখাবার তরে।
হরিচাঁদ অবতীর্ণ এ ভব সংসারে।।
হাতে কাম মুখে নাম ভক্তিই প্রবল।
বুঝেও বোঝনা কেন হয়েছে দুর্বল।।
আমার কথায় তুমি বিবাহ করিলে।
নাম প্রেম বৃদ্ধি হবে আমি যাই বলে।।
পিতার আদেশ শুনি অশ্বিনী তখন।
বিবাহ করিতে তার হইলেন মন।।
কাননচক নিবাসী সঞ্জয় মন্ডল।
সত্যবাদী জ্ঞানী গুনী হৃদয় সরল।।
তার জ্যেষ্ঠা কন্যা হয় মালঞ্চ নামেতে।
অশ্বিনীর পরিনয় হোলো তার সাথে।।
এইভাবে সংসারের দিন কেটে যায়।
সংসারের কর্ম্ম করে হরি গুণগায়।।
কিছুদিন পরে সেই শুভ লগনেতে।
এক কন্যা জনমিল তাহার গর্ভেতে।।
তাই দেখে তার পিতা আনন্দ হৃদয়।
কোলে করে সেই কন্যা হরি গুন গায়।।
বিমলা রাখিল নাম কি যেন ভাবিয়া।
সন্তষ্ট হইল সবে সে নাম শুনিয়া।।
এইভাবে সে অশ্বিনী খাটে সংসারেতে।
মজুরী খাটিতে যায় পরের জমিতে।।
বড় বেড়ে বাস করে সুধন্য পোদ্দার।
অশ্বিনীর কাকা হয় নিজ বংশধর।।
অশ্বিনীকে ভালবাসে সেই মহাশয়।
তাহার জমিতে নিয়ে মজুরী খাটায়।।
বাল্যকালে সে অশ্বিনী পোদ্দার বাটিতে।
গরু চরাইত সদা বিশুদ্ধ মনেতে।।
অশ্বিনীর গুনকথা মনেতে জানিয়া।
তাই তারে ভালবাসে নিকটে পাইয়া।।
অশ্বিনীকে বলিতেন শুন বাছাধন।
আমার জমিতে বসে করিও কীর্ত্তন।।
হরিনাম করিবারে মোর নাই মানা।
কিষাণের দাম আমি দিব ষোল আনা।।
কর্ম না করিলে আমি মূল্য তোমা দিব।
তোমার মুখেতে আমি ঐ নাম শুনিব।।
এক বন্দে দুই বিঘা মজি পরিমান।
সে জমিতে বসে করে হরি গুণ গান।।
প্রতিদিন সে জমিতে অশ্বিনীকে নিয়ে।
হরি গুনগান করে জমিতে বসিয়ে।।
এইভাবে দুই মাস গত হয়ে গেল।
এক গাছ বল কভু মারা নাহি হোল।।
আর যত জমি ছিল কিষাণ লইয়া।
আগাছার বল যত দিল নিড়াইয়া।।
সবে বলে কি দেখেছে পোদ্দার মশায়।
ঐ জমি ফাল যাবে জানিও নিশ্চয়।।
কর্ম না করিয়া যদি ফসল পাইবে।
তবে কেন মানুষেতে না খেয়ে খাটিবে।।
এইভাবে কত জনে কত কি বলিল।
যে যেমন বোঝে তাই কহিতে লাগিল।।
জলে মগ্ন হয়ে জমি বন পচে গেল।
তাহাতেই সেই ধান সতেজ হইল।।
শেষকালে দেখা গেল অন্য জমি হতে।
দ্বিগুন ফলিল ধান নামের গুনেতে।।
হরিভক্ত মুখে শুনে হরি গুনগান।
দ্বিগুন ফসল ফলে জগতে প্রমাণ।।
যারা যারা অশ্বিনীকে ঠাট্টা করেছিল।
তারা এসে অশ্বিনীর চরণে পড়িল।।
কেঁন্দে কেঁন্দে তারা সবে কহিছেন বাণী।
তুমি আজি ক্ষমা কর ওহে গুনমনী।।
অশ্বিনী বলেছে আমি কিছুই না জানি।
যার কাজ সেই করে হরি গুনমনী।।
পতিত তারিতে হরি এল এ জগতে।
হরিনামে পাপ তাপ সকলে নাসিতে।।
তাই শুনি তারা সবে হরি হরি বলে।
সেই দিন হতে তারা হরিভক্ত হলে।।
এইভাবে কেটে যায় সংসার জীবন।
সংসার করিতে তার নাহি লয় মন।।
দাম্পত্য জীবনে তার মোটে শান্তি নাই।
দুইভাবে দুটি প্রাণ মিলিয়াছে তাই।।
সংসার বিরাগী হয়ে ঘুরিয়ে বেড়ায়।
হরিচাঁন্দ গুনগান গাহিত সদায়।।
এইভাবে কতদিন গত হয়ে গেল।
জ্বর হয়ে তার পিতা ভূগিতে লাগিল।।
একদিন অশ্বিনীকে ডেকে এনে কয়।
শুন শুন রে অশ্বিনী বলি যে তোমায়।।
আনারস খেতে ইচ্ছা মনে জাগিতেছে।
এনে দাও আনারস বলি তব কাছে।।
পিতৃ বাক্য শুনি কানে অশ্বিনী তখন।
ভক্তি গদগদ চিত্ত ঝর দুনয়ন।।
পিতৃভক্ত সে অশ্বিনী করিল গমন।
কোথা পাবে আনারস ভাবে মনে মন।।
অকালেতে আনারস কোথা গিয়ে পাই।
মনে মনে সে অশ্বিনী ভাবিতেছে তাই।।
কভু যদি আনারস মিলাতে না পারি।
জীবন ত্যাজিব আমি বলে হরি হরি।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ রাখিয়া অন্তরে।
পথ বেয়ে চলে রত্ন আখি দুটি ঝরে।।
অন্তরে জানিয়া তাহা হরি দয়াময়।
আনারস বাগানেতে তখনে জন্মায়।।
বড় বেড়ে রাস্তা গিয়া অশ্বিনী হাটিছে।
পাকা আনারস ঘ্রাণ নাকেতে লেগেছে।।
যেই দিকে ঘ্রাণ আসে সেই দিকে যায়।
গিয়ে সেই বাগানেতে দেখিবারে পায়।।
বড় এক আনারস গাছে পাকিয়াছে।
তাই দেখে সে অশ্বিনী মনেতে ভেবেছে।।
মালিকের কাছে গিয়ে কহিল তখন।।
শুন শুন মহাশয় আমার বচন।।
কয়দিন মোর পিতা জ্বরে ভূগিতেছে।
মোর কাছে আনারস খেতে চাহিয়াছে।।
কোনখানে আনারস খুজিয়া না পাই।
তোমার বাগানে গিয়ে দেখিলাম তাই।।
বড় এক আনারস পেকে রহিয়াছে।
এই আনারস আমি চাই তব কাছে।।
কত মূল্য দিব আমি বলহে আমায়।
এই আনারস আমি খাওয়াব পিতায়।।
মালিক বলেছে আমি ভাবিয়া নাই পাই।
মোর গাছে আনারস কভু দেখি নাই।।
রোজ রোজ আমি সেই বাগানেতে যাই।
পাকা ফল গাছে আছে দেখিতে না পাই।।
ফল যদি গাছে থাকে তোমা আমি দিব।
আনারস মূল্য আমি কিছু নাহি লব।।
তখনেতে দুইজনে বাগানেতে যায়।
বড় এক আনারস দেখিাবরে পায়।।
মালিক বলেছে সেই অশ্বিনীর ঠাই।
ফল নিয়ে চল বাবা তব সঙ্গে যাই।।
আনারস সঙ্গে নিয়ে চলে দুইজন।
অশ্বিনীর বাড়ী গিয়ে দিল দরশন।।
অশ্বিনীর পিতা সেই আনারস খেয়ে।
আর্শীবাদ দেয় তারে দুবাহু তুলিয়ে।।
শুন শুন বাছাধন বলি যে তোমায়।
জীবের কল্যাণ যেন তোমা দ্বারা হয়।।
সকলেরে বলে কয়ে কার্ত্তিক সুজন।
হরি হরি হরি বলি ত্যাজিল জীবন।।
তাই দেখে সে অশ্বিনী কেঁন্দে ছাড়ে হাই।
পরিবার সহ তারা কাঁন্দিছে সবাই।।
পাড়া প্রতি সবে এসে সান্তনা করিয়া।
শব দাহ করিলেন সকলে মিলিয়া।।
একাদশ দিনে করে শ্রাদ্ধাদি অর্পন।
ভিক্ষা করি করালেন স্বজাতি ভোজন।।
সংসারে থাকিয়া সদা হরি হরি বলে।
মহাভাব উথলিয়া ভাসে আখ জলে।।
মাঝে মাঝে সে অশ্বিনী ওড়াকান্দি যায়।
গুরুচাঁন্দ পোষা পাখি হরি গুন গায়।।
অধম বিনোদ বলে বেলা বেশি নাই।
হরিচাঁন্দ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।
******অশ্বিনীর ত্যাগের কথা*******
গুরুচাঁদ পোষা পাখি অশ্বিনী গোসাই।
হরিনাম ভিন্ন তার অন্য গতি নাই।।
সংসারেতে বাস করে সংসারী সাজিয়া।
সুখ দুখ সমজ্ঞান মনেতে ভাবিয়া।।
ভক্ত মন বুঝিবারে হরি দয়াময়।
দুঃখ কষ্ট দিয়ে তারে পরীক্ষা করয়।।
সংসারের দৈন্য দশা ক্রমেতে বাড়িল।
তবু নাহি হরিনাম ভুলিয়া রহিল।।
লহ্মীখালী বাস করে গোপাল সাধু।
দিবানিশি পান করে হরিনাম মধু।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ অন্তরে ভাবিয়া।
দক্ষিণ দেশ মাতাল হরি নাম দিয়া।।
ওড়াকান্দি যাব বলে করিলেন মন।
কয়জন ভক্ত সঙ্গে করিলেন গমন।।
ভাবে গদগদ চিত্ত বলে হরি হরি।
সন্ধ্যাবেলা উপনীত অশ্বিনীর বাড়ী।।
তাই দেখে সে অশ্বিনী গলে বস্ত্র দিয়া।
ছল ছল আখি দুটি কহিছে কান্দিয়া।।
শুন শুন ওরে ভাই আমার বচন।
অধমের নিবেদন করহে গ্রহণ।।
ঠাকুরের ঘর বাড়ী মোর কিছু নয়।
দিন গত আমি আছি তাহার আলয়।।
এইভাবে ভক্তি করি বসিবারে দিল।
হরিধ্বনি করি সবে আসনে বসিল।।
অশ্বিনীর চক্ষুজলে বক্ষ ভেসে যায়।
সকলের পদধুলি লইল মাথায়।।
তাই দেখে সে গোপাল কাঁন্দিয়া কাঁন্দিয়া।
অশ্বিনীর চরণেতে পড়িল ঢলিয়া।।
হরিভক্ত ছিল যত গোপালের সাথে।
গড়াগড়ি যায় সবে পড়িয়া মাটিতে।।
হরি হরি বলে সবে কাঁন্দিতে লাগিল।
বহুক্ষণ পরে শেষে প্রেম সম্বরিল।।
তারপর সবে মিলে করিছে কীর্ত্তন।
তাই দেখে সে অশ্বিনী ভাবে মনে মন।।
ঘরেতে তন্ডুল নাহি কি হবে উপায়।
নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।।
ধামা হাতে চলিলেন গ্রামের ভিতর।
বাড়ী বাড়ী ভিক্ষা করি আসিল সত্বর।।
কোন মতে ডাল ভাত রন্ধন হইল।
হরি বলে ভক্তগনে ভোজন করিল।।
অশ্বিনীর দৈন্য দশা পোগাল জানিয়া।
অশ্বিনীর হস্ত ধরে কহিছে কান্দিয়া।।
চল ভাই ওড়াকান্দি গুরুচাঁদ ঠাই।
তার কাছে গিয়ে মোরা সকল জানাই।।
অশ্বিনী বলেছে ভাই তোমাকে শুধাই।
মোর মত অভাজন এ জগতে নাই।।
ভক্তিহীন জ্ঞানহীন জগতে আসিয়ে।
সেবা করাইতে নারি হরিভক্ত পেয়ে।।
এই কথা বলে রত্ন কান্দিতে লাগিল।
পোগাল চরণ ধরে আবেগে কহিল।।
শুন শুন শুন ভাই তোমাকে জানাই।
তোমা সম হরি ভক্ত এ জগতে নাই।।
প্রেমরসে তনু মাখা হরিভক্ত তুমি।
তোমার তুলনা দিতে নাহি জানি আমি।।
এইভাবে প্রেমালাপ হইতে লাগিল।
হরি কথা রসরঙ্গে সে নিশি কাটিল।।
প্রভাতে উঠিয়া সবে হরি গুন গায়।
হাত মুখ ধুয়ে সবে পান্তা ভাত খায়।।
পান্তা সেবা করি শেষে মিলিয়া সকলে।
ওড়াকান্দি করে যাত্রা হরি হরি বলে।।
পথে যেতে সকলেতে হরি গুণ গায়।
অশ্বিনীর চক্ষু জলে বক্ষ ভেসে যায়।।
ঘৃতকান্দি গিয়ে সবে মনের আবেগে।
হরি হরি বলে সবে চলে দ্রুতবেগে।।
অশ্বিনী অনেক পিছে পড়িয়া রহিল।
মনে মনে সে অশ্বিনী ভাবিতে লাগিল।।
সকলেতে লইয়াছে নানাবিধ দ্রব্য।
মোর কাছে কিছু নাই কোথা বা কি পাবো।
মাঠ মধ্যে গিয়ে তিনি ভাবিতে লাগিল।
দুই হাতে দুই ঢেলা ধারণ করিল।।
এই মাটি লযে আমি শ্রীধামেতে যাব।
তাতে কিবা আমি ভারী অপরাধী হবো।।
মাটি গলে মাটি হবে শ্রীধামেতে রবে।
এইটুকু উপকার মোর দ্বারা হবে।।
আগে আগে সবে যারা শ্রীধামে উঠিল।
গুরুচাঁদ পদে গিয়ে প্রণাম করিল।।
হরি বলে গুরুচাঁদ আশীর্বাদ দিল।
সকলে মঙ্গলে থাক মুখেতে বলিল।।
যেবা যাহা নিয়েছিল রাখিল তথায়।
গুরুচাঁদ চরণেতে সকল জানায়।।
গদিঘর পিছনেতে অশ্বিনী বসিয়া।
নয়নের জলে বক্ষ যেতেছে ভাসিয়া।।
গুরুচাঁদ ছবিখানি হৃদয় ধরিয়া।
প্রেমভরে স্ততি করে কাঁন্দিয়া কাঁন্দিয়া।।
আমি বড় অভাজন কোন কিছু নাই।
কি দিয়া বাসিব ভাল চরণে জানাই।।
ওদিকেতে গদিঘরে গুরুচাঁদ কয়।
তোমরা আসিলে সবে অশ্বিনী কোথায়।।
তোমরা আনিলে যাহা দেখিবারে পাই।
অশ্বিনী আনিবে যাহা আগে খাব তাই।।
একজন বলে এসে গুরুচাঁদ কাছে।
ঘরের বাহিরে বসে অশ্বিনী রয়েছে।।
দুই দলা ঢেলা মাটি দুই হাতে ধরি।
বসে বসে কাঁদিতেছে বলে হরি হরি।।
তাই শুনে গুরুচাঁদ বাহিরেতে যায়।
দুই খন্ড মিছরি হাতে দেখিবার পায়।।
তাই নিয়ে গুরুচাঁদ মুখেতে পুরিল।
কড়মড় শব্দ করি খাইতে লাগিল।।
অশ্বিনী পড়িল ঢলে গুরুচাঁদ পায়।
কেঁদে কেঁদে চরণেতে গড়াগড়ি যায়।।
অশ্চর্য্য দেখিয়া সবে কাঁদিতে লাগিল।
কেঁদে কেঁদে গুরুচাঁদ চরণে পড়িল।।
কেহ কেহ কেঁদে বলে ওগো দয়াময়।
তোমার চরণ বিনে দাঁড়াব কোথায়।।
তাই দেখে গুরুচাঁদ কহিতে লাগিল।
শান্ত হযে সবে মিলে গদি ঘরে চল।।
এই কথা বলে প্রভু গদিতে বসিল।
শান্ত হয়ে সবে গিয়ে প্রণাম করিল।।
প্রণাম করিয়া সবে চারিদিকে বসে।
অশ্বিনী পিছনে বসে আখি জলে ভাসে।।
কাঁদিয়া গোপাল বলে গুরুচাঁদ ঠাই।
শুন শুন শুন প্রভু তোমাকে জানাই।।
অশ্বিনী দাদার কথা জানাই চরণে।
ভিক্ষা করে খেতে দেয় হরি ভক্তগণে।।
করজোড়ে ওগো প্রভু তোমাকে জানাই।
অশ্বিনীকে কর দয়া এই ভিক্ষা চাই।।
তাই শুনি গুরুচাঁদ হাসি হাসি কয়।
অশ্বিনীকে ডেকে আন দিব যাহা চায়।।
তাই শুনি অশ্বিনীকে ডাকিয়া আনিল।
করোজোড়ে সে অশ্বিনী আসিয়া দাঁড়ায়।।
গুরুচাঁদ ডেকে বলে শুনহে অশ্বিনী।
মোর কাছে কিবা চাও বল তাই শুনি।।
তাই শুনি সে অশ্বিনী কেঁদে কেঁদে কয়।
এক নিবেদন করি তব রাঙ্গা পায়।।
অভাবের তাড়নায় ভিক্ষা লাগি যাই।
তাও যেন নাহি দেয় এই বর চাই।।
অন্য
কিছু নাহি চাই চরণে জানাই।।
অন্তিত কালেতে যেন শ্রীচরণ পাই।
প্রেম ভক্তি কিছু নাই ওগো দয়াময়।
দয়া করে অধমের রেখ রাঙ্গা পায়।।
অশ্বিনীর কথা শুনে গুরুচাঁদ কয়।
শুন শুন ও গোপাল বলি যে তোমায়।।
অশ্বিনীর কথা কিছু শুনিলে এখন।
আমি তারে কি করিব বল বাছাধন।।
হরিকল্প তরুমূলে বাসনা যে করে।
মনের বাসনা পূর্ব আমি করি তারে।।
শুনিয়া গোপাল বড় বিস্ময় মানিল।
মনের বেদনা তার মনে রয়ে গেল।।
অশ্বিনীর কাছে গিয়ে সে গোপাল কয়।
শুন শুন ওগো দাদা বলি যে তোমায়।।
তোমার মনের কথা আমি জানি নাই।
তোমা সম হরিভক্ত খুজিয়া না পাই।।
করিয়াছি অপরাধ ক্ষমা কর মোরে।
চরণ ধরিয়া তারে সান্তনা করায়।।
তারপর সবে মিলে গুরুচাঁদ কয়।
তোমার চরণ বিনে দাঁড়াব কোথায়।।
যে যাহার মন কথা গুরুচাঁদ বলি।
পরদিন সবে মিলে দেশে গেল চলি।।
এ দীন বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে।
হরিচাঁদ ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ওরে মন বেলা বেশি নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।
******অশ্বিনীর পরীক্ষা*******
দেশে গিয়ে সে গোপাল ভাবে মনে মন।
অশ্বিনীর সেই কথা জাগে সর্বক্ষণ।।
পরীক্ষা করিতে যাব গঙ্গাচন্না গায়।
কেমন ত্যাগের ধর্ম বুঝাব তোমায়।।
দশজন হরিভক্ত সঙ্গেতে করিয়া।
যাত্রা করে সবে মিলে শ্রীহরি স্মরিয়া।।
পথে যেতে হরি কথা বলিতে বলিতে।
ভাবে গদ গদ চিত্ত চলেছেন পথে।।
এইভাবে পথে যেতে ভাবিতে লাগিল।
সন্ধ্যাবেলা গঙ্গাচন্না উপনীত হল।।
হরি হরি বলে সবে উঠিল বাড়ীতে।
দেখিয়া অশ্বিনী এসে লাগিল কাঁদিতে।।
হরিভক্ত চরণেতে কেঁদে কেঁদে কয়।
তোমাদের বাড়ীঘর মোর কিছু নয়।।
জল পাত্র এনে শেষে পা ধোয়াতে যায়।
সকলে পড়িল এসে অশ্বিনীর পায়।।
সে গোপালে ধরে তোলে অশ্বিনী সুজন।
গোপালকে বুকে ধরে করে অলিঙ্গন।
এইভাবে প্রেমাবেশে ধরাধরি করে।
হস্তপদ ধুয়ে সবে বসিলেন ঘরে।।
খেজুরের পাতা দিয়া বিছানা করেছে।
তাহা বিছাইয়া শেষে বসিতে দিয়াছে।।
ঘরেতে তন্ডুল নাস্তি অশ্বিনী জানিয়া।
গ্রামেতে চলিল তিনি ধামা হাতে নিয়া।।
এদিকেতে ঘরে বসে বলে একজন।
গোপাল সাধুকে ডেকে কহিল তখন।।
উপরেতে চেয়ে দেখ তারা দেখা যায়।
ঘরেতে ছাউনি নাই জানাই তোমায়।।
ঝড় বৃষ্টি আসে যদি কি হবে উপায়।
অন্য বাড়ী যাই মোরা থাকিতে সময়।।
তাই শুনি সে গোপাল করিতেছে মানা।
ও কথা বলনা ভাই বৃষ্টিত হবেনা।।
অন্য কথা দিয়া আর কার্য্য কিছু নাই।
এস মোরা সবে মিলে হরি গুণ গাই।।
গোপালের কথা শুনে নামেতে মাতিল।
হরি গুনগানে তারা প্রমত্ত হইল।।
ওদিকেতে সে অশ্বিনী ঘুরিয়া বেড়ায়।
যে বাড়ীতে যায় তারা ভিক্ষা নাহি দেয়।।
গ্রাম ভরি সব বাড়ী ঘুরিতে লাগিল।
এক মুঠি ভিক্ষা তাকে কেহ নাহি দিল।।
নিরূপায় হয়ে রত্ন কাঁদিতে লাগিল।
গুরুচাঁদ ছবিখানি হৃদয় জাগিল।।
কেদে বলে ওগো প্রভু চরণে জানাই।
যাহা চাহিয়াছি আমি দিলে আজি তাই।।
যেমন মানুষ আমি তেমন পেয়েছি।
হরিভক্ত সেবা বাদ তাহা কি চেয়েছি।।
তব ভক্ত ঘরে বসে হরিনাম করে।
কেমনে হইবে সেবা কহ আজ মোরে।।
হরি ভক্তগণ যদি থাকে অনাহারে।
নামের কলঙ্গ হবে এভব সংসারে।।
আমার জীবনে যত দুঃখ কষ্ট হয়।
তাতে আমি ভাবিনাক ওগো দয়াময়।।
এত ভাবি সে অশ্বিনী কেদে ছাড়ে হাই।
তুমি যাতে সুখে থাক এই ভিক্ষা চাই।।
কিছু দুরে ছিল এক কমদের গাছ।
সেই গাছ বুকে ধরে কাদিতেছে আজ।।
নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।
কি করিবে কোথা যাবে ভাবিয়া না পায়।।
ঘোর অন্ধকার রাত্রি ধাদিল নয়ন।
চারিদিকে হইতেছে মেঘের গর্জন।।
মেঘের গর্জন শুনে গোপাল ভেবেছে।
মনে মনে গুরুচাদে চরণে বলেছে।।
শুন শুন গুরুচাঁদ জানাই তোমায়।
ঝড় বৃষ্টি হলে পরে দাড়াব কোথায়।।
কাঙ্গালের বন্ধু তুমি করুনা নিদান।
তব ভক্ত রক্ষা কর করে কৃপা দান।।
গোপালের চক্ষু জলে বক্ষ ভেসে যায়।
ওড়াকান্দি গুরুচাঁদ জানিবারে পায়।।
ভক্তের বিপদ জেনে শ্রীহরি নন্দন।
শ্রীনাথ পাগলে ডেকে কহিল তখন।।
ছাতা এনে দাও তুমি অতি শ্রীঘ্র করি।
ভক্তের বিপদ আমি সহিতে না পারি।।
তখনি শ্রীনাথ ছাতা আনিয়া যোগায়।
গদি ঘরে বসে প্রভু ছাতা মাথে দেয়।।
চারিদিকে ঝড় বৃষ্টি হল অতিশয়।
অশ্বিনীর বাড়ী মেধ্য কিছু নাহি হয়।।
দুই রাশি আড়ে দিঘি হবে অনুমান।
ঝড় বৃষ্টি না হইল রহেছে প্রমাণ।
এ হেন আশ্চর্য্য লীলা কভু দেখি নাই।।
এই যুগে দেখে শুনে মানিলাম তাই।।
অশ্বিনীর কান্না শুনে গুরুচাঁদ কয়।
ওগো বাবা হরিচাঁদ চলিয়ে তোমায়।।
সেই যাহা চেয়েছিল আমি দিনু তাই।
এবে আমি কি করিব চরণে জানাই।।
তব ভক্তগণ সব অনাহারে আছে।
অশ্বিনীর ঘরে বসে হরিনাম নিছে।।
ওগো বাবা হরিচাঁদ কি হবে উপায়।
তোমার নামের বুঝি কলঙ্ক রটায়।।
কৃপা করে কৃপাসিন্ধু দয়াময় হরি।
তোমার ভক্তের ব্যাথা সহিতে না পারি।।
এত ভাবি গুরুচাঁদ ছাড়ে আখিজল।
অন্তরে জানিল তাহা পরম দয়াল।।
ভক্তের লাগিয়া আজি দয়াময় হরি।
শূণ্যেতে ভাসিল এক ব্যাঘ্র পৃষ্ঠে চরি।।
রঘুনাথপুর গ্রাম দিকজয় নাম।
চাউলের কেনা বেচা করে গুণধাম।।
চিতলমারী হাটেতে করেছে গমন।
গঙ্গাচন্না খালমুখে আসিল যখন।।
মধুমতি হতে খাল গঙ্গাচন্না এল।
গোড়া খালে সেই নৌকা চরায় ঠেকিল।।
জলে নেমে ভাগিগন ঠেলাঠেলি করে।
তবু সেই নৌকাখানি কিছুতে না নড়ে।।
কুলে নেমে দিকজয় করে হায় হায়।
কি করিবে কোথা যাবে ভাবিয়া না পায়।।
ঘোর অন্ধকারে রাত্রি চারিদিকে চায়।
কিছু দুরে আলোময় দেখিবারে পায়।।
দ্রুতগতি গিয়ে দেখে আশ্চর্য্য কাহিনী।
ব্যাঘ্র পৃষ্ঠে বসা আছে হরি গুনমণী।।
হরিচাঁদ বলে শুন ওরে দিকজয়।
নৌকা নিয়ে চলে যাও গঙ্গাচন্না গায়।।
অশ্বিনী নামেতে মোর ভক্ত একজন।
বিপদে পড়িয়া সে যে করেছে রোদন।।
মোর ভক্ত অনাহারে আছে তার ঘর।
শুন শুন দিকজয় বলি যে তোমারে।।
চাউল তাহারে দিয়ে এস শীঘ্রগতি।
তারপর হেটে যেও ওহে মহামতি।।
এই বাক্য বলে হরি অদৃশ্য হইল।
দিশেহারা দিকজয় মাটিতে পড়িল।।
আখি জলে ভেসে ভেসে দিকজয় বলে।
অভাগারে দেখাদিয়ে কেন লুকাইলে।।
আমি বড় অপরাধী এই দুনিয়ায়।
নিজ গুনে দেখা দিলে ওগো দয়াময়।।
কাদিতে কাদিতে গেল নৌকার নিকটে।
ভাগিদের কাছে গিয়ে কহে করপুটে।।
জল হতে নৌকা পরে সকলেতে যাও।
হরিচাঁদ নাম নিযে তরী খুলে দাও।।
গঙ্গাচন্না খাল বেয়ে যেতে হতে ভাই।
তাহা নাহি হলে পরে আর রক্ষা নাই।।
তাই শুনে সবে মিলে নৌকায় উঠিল।
হরিচাঁদ নাম নিয়ে তরুনী বাহিল।।
দ্রুতবেগে চলে তরী সেই খাল বেয়ে।
অশ্বিনীর ঘাটে গিয়ে পড়িল ঠেকিয়ে।।
তাই দেখে দিকজয় ডেকে কয় কথা।
অশ্বিনী নামেতে কেউ আছে নাকি হেথা।।
তাই শুনি সে অশ্বিনী কাঁদিয়া উঠিল।
হরি বলে হাই ছেড়ে কহিতে লাগিল।।
ওগো বাবা গুরুচাঁদ কি খেলা তোমার।
তব লীলা বুঝিবারে কি সাধ্য আমার।।
কয়জন অনাহারে আছে মম ঘরে।
এখন আসিলে কেবা দুঃখ সহিবারে।।
তাই ভেবে সে অশ্বিনী ছাড়িতেছে হাই।
দিকজয় বলে কেবা কাঁদিতেছ ভাই।।
অশ্বিনী বলে আমি বড় অভাজন।
অশ্বিনী আমার নাম তুমি কোন জন।।
তাই শুনি দিকজয় চরণে পড়িল।
কেদে কেদে দিকজয় কহিতে লাগিল।।
হরিচাঁদ প্রিয় ভক্ত মহাজন।
আমাকে পাঠালে হরি তোমার কারণ।।
হরিভক্ত অনাহারে তব ঘরে আছে।
দেখা দিয়ে হরি আজি আমাকে বলেছে।।
চাউলের নৌকা নিয়ে এসেছিরে ভাই।
যে চাউল দরকার আমি দিব তাই।।
এক কথা বলে সে যে কাদিতে লাগিল।
কান্না শুনে আলো জ্বেলে সকলে আসিল।।
আদি অন্ত সব কথা সকলে শুনিয়া।
গড়াগড়ি যায় সবে মাটিতে পড়িয়া।।
কেহ কেহ কেদে কেদে হল অচেতন।
লেখা দিয়া কি বুঝাব আমি অভাজন।।
বহুক্ষণ পরে শেষে সে কান্না থামিল।
দিকজয় নৌকা হতে চাউল আনিল।।
সে চাউল দিয়ে শেষে রন্ধন হইল।
প্রেমভরে ভক্তগন ভোজন করিল।।
সারানিশি কেদ কেদে করিল কির্ত্তণ।
ভাষা দিয়া কি বুঝাব আমি অভাজন।।
অনেক হইল বেলা বাহ্যজ্ঞান নাই।
হরি বলে কেদে কেদে ছাড়িতেছে হাই।।
এইভাবে ভাবাবেষে মধ্যাহ্ন হইল।
গ্রামবাসী সবে এসে রন্ধন করিল।।
তারপর সকলেতে ভোজন করিয়া।
যার যার দেশে সবে গেল চলিয়া।।
বেলা গেল দিকজয় নৌকায় উঠিণ।
হরি বলে নৌকা বেয়ে হাটে চলে গেল।।
চর্তুগুণ লভ্য হলো সেই হাটে গিয়ে।
হির বলে দিকজল বেড়ায় নাচিয়ে।।
এ হেন আশ্চর্য্য লীলা কে দেখেছে বল।
সেই হতে দিকজয় মতুয়া হইল।।
এ দীন বিনোদ বলে পাচালীর ছন্দে।
হরিচাঁদ ছবিখানা হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ভাইসব বেলা বেশি নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।
******নাম হতে ভক্ত বড়*******
জগতে আমিল এক হরি বোলা পাখি।
হরিনাম উচ্চারণে ঝরে দুটি আখি।।
নামে প্রেমে মত্ত হয়ে মহাভাবে রয়।
দিবানিশি হরি গুণ গাহিয়া বেড়ায়।।
একদিন সে অশ্বিনী ভাবে মনে মন।
ওড়াকান্দি যাব বলে করিল গমন।।
প্রতি বুধবারে তিনি ওড়াকান্দি যায়।
এইভাবে যাতায়াত করে মথাশয়।।
বুধবারে চলেছেন ওড়াকান্দি পথে।
জলে ভরা আখি দুটি লাগিল হাটিতে।
মুখে হরি হরি গুণ গাহিতে গাহিতে।
উদয় হইল গিয়ে গোপালগঞ্জতে।।
কয়জন হরিভক্ত আসিয়া মিশিল।
তাহারাও ওড়াকন্দি যাইবে বলিল।।
একসঙ্গে চারিজন করিল গমন।
উলপুর খেয়াঘাটে দিল দরশন।।
খেয়াপার হয়ে শেষে ও পারেতে গেল।
হরি হরি বলে সবে হাটিতে লাগিল।।
কিছু দুর গিয়ে তারা দেখিবারে পায়।
করোজোড়ে এক মেয়ে আসিয়া দাড়ায়।।
অশ্বিনীর চরনেতে প্রণাম কিরল।
জলে ভরা অখি দুটি কান্দিতে লাগিল।।
কেদ কেদে কহিলেন অশ্বিনীর ঠাই।
কোথায় চলেছ তুমি শুনিবারে চাই।।
অশ্বিনী বলেছে মাগো তোমাকে জানাই।
হরি বলে আজি মোরা ওড়াকান্দি যাই।।
মিনতী কহিছে কেদে মিনতি করিয়া।
তথা গেলে কিবা হয় কহ বিস্তারিয়া।।
অশ্বিনী বলেছে ওড়াকান্দি যেবা যায়।
সকল মনের বাঞ্ছা তার পূর্ণ হয়।।
মিনতী কহিছে আমি বড় অভাগিনী।
শুন তুমি হরি ভক্ত আমার কাহিনী।।
বহুদিন গত হল বিবাহ হয়েছে।
কিন্তু এক ব্যাথা মোর মনেতে রয়েছে।।
বন্ধ্যা বলে ভাল কেউ বাসেনা আমায়।
দিবানিশি কেদে ফিরি সেই বেদনায়।।
অশ্বিনী বলেছে মাগো বাঞ্ছা পূর্ণ হবে।
স্বামীকে সঙ্গেতে করি ওড়াকান্দি যাবে।।
ওড়াকান্দি হরি এসে অবতীর্ণ হলো।
লীলা সাঙ্গ করে তিনি ক্ষীরদেতে গেল।।
তার পুত্র গুরুচাঁদ বর্তমান আছে।
মনবাঞ্ছা পূর্ণ হবে গেলে তার কাছে।।
এই কথা বলে রত্ন গমন করিল।
আশা পেয়ে সেই নারী গৃহেতে চলিল।।
শ্রীউপেন্দ্রনাথ নাম কায়স্থ জাতিতে।
ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট সে উচ্চ পদেতে।।
বিত্তশালী মহামান্য অর্থের বড়াই।
অর্থ আছে পুত্র কন্যা তার ঘরে নাই।।
স্বামীর চরণে গিয়ে মিনতী কহিল।
মোরে নিয়ে ওগো স্বামী ওড়াকন্দি চল।
মহাপ্রভু গুরুচাঁদ ওড়াকন্দি আছে।
মনবাঞ্ছা পূর্ণ হবে গেলে তার কাছে।।
উপেন্দ্র বলেছে সেই মিনতীর ঠাই।
নারী জাতি বলে তব জ্ঞান কান্ড নাই।।
নমঃশুদ্র ঘরে কেন ঠাকুর জন্মিবে।
দেখিয়া আমার মনে ভক্তি না আসিবে।।
তোমা লয়ে আমি কবু যেতে না পারিব।
পুত্র কন্যা না হউক এইভাবে রব।।
বড় বড় ডাক্তার কত দেখায়েছি।
আমাদের ভাগ্যে নাই মনেতে জেনেছি।।
শনিয়া স্বামীর বানী মিনতী তখন।
ছলছল আখি দুটি ঝরে দুনয়ন।।
মৌন হয়ে থাকে সদা কথা নাহি কয়।
নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।।
এইভাবে কতদিন গত হয়ে গেল।
মনের বেদনা তার মনেতে রহিল।।
একদিন তার স্বামী সেভাবে দেখিয়া।
মিনতীর মনোভাব বুঝিতে পারিয়া।।
কহিলেন শুন তুমি আমার বচন।
ওড়াকান্দি যেতে হবে করেছি মনন।।
কার কাছে শুনিয়াছ ঠাকুরের কথা।
সেই মহাজন কেবা কানকি বারতা।।
স্বপনেতে দেখিয়াছি পুরুষ রতন।
অজানুলম্বিত ভুজ আকর্ন লোচন।।
সে মানুষ স্বপনেতে কহিলেন কথা।
আমার ভক্তের কথা না হবে অন্যথা।।
যে তোমারে বলিয়াছে তারে কোথা পাই।
তারে লয়ে চল মোরা ওড়াকান্দি যাই।।
মিনতী কহিছে আমি তার দেখা পাব।
আমাদের সঙ্গে যেতে তাহাকে কহিব।।
মিনতীর অন্তরেতে ভক্তির উদয়।
মনে মনে ভাবিতেছে কি করি উপায়।।
সেই হরি ভক্ত দেখা কোথা গিয়ে পাব।
আমার মনের কথা তাহাকে জানাব।।
কবে সেই বুধবার মনেতে ভাবিয়া।
এইভাবে দিনগুলি রাখিছে গণিয়া।।
যেইদিন বুধবার মনেতে জানিল।
অনাহারে সে মিনতী রাস্তায় দাড়াল।।
ছল ছল দুটি আখি পথ পানে চায়।
এই আসে এই আসে ভাবিছে হৃদয়।।
একটার পরে শেষে দেখিতে পাইল।
অশ্বিনী আসিয়া সেথা উদয় হইল।।
অমনি মিনতী গিয়ে চরণে পড়িল।
চরণ ধরিয়া শেষে কাদিতে লাগিল।।
কেদে কেদে সে মিনতী লাগিল বলিতে।
স্বামীর হয়েছে মন ওড়াকন্দি যেতে।।
আমাদের লয়ে তুমি ওড়াকন্দি চল।
অশ্বিনী বলেছে মাগো হইবে মঙ্গল।।
তাই শুনি সে মিনতী দুটি হাতে ধরি।
বাড়ী মধ্যে নিয়ে গেল অতি যত্ন করি।।
যত্ন করি সে মিনতী ধোয়াল চরণ।
তারপরে ভক্তির ভরে করাল ভোজন।।
ভোজনান্তে আচমন করিল গোসাই।
বলে মাগো চল শীঘ্র ওড়াকন্দি যাই।।
উপেন্দ্র মিনতী দোহে করিয়া ভোজন।
একসঙ্গে সবে মিলে করিল গমন।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ।
ভাবে গদ গদ চিত্ত ঝরে দুনয়ন।।
অগ্রভাগে চলিতেছে অশ্বিনী সুজন।
পিছনেতে চলে তারা আনন্দিত মন।।
এইভাবে চলে তারা বলে হরি হরি।
উদয় হইল গিয়ে ওড়াকন্দি বাড়ি।।
অশ্বিনী বলেছে মাগো শুন দিয়া মন।
কামনা সাগরে স্নান কর দুইজন।।
তাই শুনি দুইজনে কামনা করিয়া।
কামনা সাগরে স্নান করিলেন গিয়া।।
তারপর চলিলেন গুরুচাঁদ কাছে।
গদিঘরে গুরুচাঁদ বসিয়া রহেছে।।
চারিদিকে ভক্তগন মাঝে গুরুচাঁদ।
তারাগণ মধ্যে যেন আকাশের চাঁদ।।
কিবা শোভা হইতেছে প্রেমানন্দময়।
ভক্তগনে হরি বলে আনন্দ হৃদয়।।
তাই দেখে সে মিনতী চরণে পড়িল।
গুরুচাঁদ পদ ধরি কাঁদিতে লাগিল।।
তাই দেখে গুরুচাঁদ কহিল তখন।
বন্ধা নারী গর্ভে কভু হবে না নন্দন।।
হেন বাক্য গুরুচাঁদ যখনেতে কয়।
উপেন্দ্র পড়িল গিয়া গুরুচাঁদ পায়।।
মিনতী উপেন্দ্র দোহে কাঁদিতে লাগিল।
কান্না দেখে গুরুচাঁদ বলিয়া উঠিল।।
তোমাদের ঘরে কভু পুত্র কন্যা নাই।
স্বচোক্ষেতে আমি তাহা দেখিবারে পাই।।
হেন বাক্য শুনে তারা কেঁদে ছাড়ে হােই।
ঘরেতে যাবনা ফিরে কহিলাম তাই।।
তোমার চরণে আজি জীবন ত্যাজিব।
মানব জীবন ধরে কিবা ফল পাব।।
গুরুচাঁদ বলে ভাল ঠেকাইলি দায়।
আমা দ্বারা কোন কিছু না হবে উপায়।।
মোর পিতা হরি চাঁদ বলিত বচন।
আমা হতে নাম বড় সংসার ভুবন।।
নাম হতে ভক্ত বড় এই দুনিয়ায়।
মনবাঞ্ছা পূর্ণ হবে ভক্তের দ্বারায়।।
এইখানে আছে কত হরি ভক্তগন।
ধর গিয়া ইহাদের যুগল চরণ।।
তাই শুনে দুইজনে ভক্ত কাছে যায়।
যার কাছে যায় সেই ভয়েতে পালায়।।
এক একে গদি ঘর শূণ্য হয়ে গেছে।
একপাশে সে অশ্বিনী দাঁড়াইয়া আছে।।
মনে মনে সে অশ্বিনী গুরচাঁদে কয়।
অধমের প্রতি বুঝি কঠিন হৃদয়।।
অধম এনেছে ডেকে এই দুইজন।
তব কৃপা হল নাক ইহার কারণ।।
জলে ভরা আখি দুটি দাঁড়াইয়া আছে।
তাই দেখে সে মিনতী চরণে পড়েছে।।
কেঁদে বলে ওগো বাবা চরণে জানাই।
তুমি ছাড়া এ জগতে আর কেহ নাই।।
এইভাবে দুইজনে কাঁদিতে লাগিল।
কান্না দেখে অশ্বিনীর দয়া উপজিল।।
মস্তকেতে হস্ত দিয়া কহিল অশ্বিনী।
এই বর্ষ মধ্যে তুই হইবি গর্ভিনী।।
সেই গর্ভে ছেলে হবে দেখিবারে পাই।
এখানে থাকিয়া মাগো আর কার্য্য নাই।।
অধমের কথা যদি সত্য না হইবে।
শ্রীধামেতে এ অশ্বিনী আর না আসিবে।।
গুরুচাঁদ পরণেতে প্রণাম করিয়া।
দুজনারে লয়ে দেশে আসিল চলিয়া।।
সেই দিন ঘরে এসে রিতুবতী হল।
সেই হতে মিনতীর গর্ভ দেখা দিল।।
তাহা জেনে সে উপেন্দ্র ভাবিতে লাগিল।
ভক্তির উদয় হল প্রেমেতে মাতিল।।
হৃদয় চঞ্চল হয়ে মনে মনে কয়।
অশ্বিনীর দেখা আমি পাইব কোথায়।।
মিনতীকে বক্ষে ধরি কেঁদে কেঁদে কয়।
শুন শুন ওগো প্রিয়ে বলিযে তোমায়।।
মানুষ চিনিয়া তুমি আনিলে বাড়ীতে।
আমা হতে ধন্য তুমি আসিয়া জগতে।।
আমি মোর মন প্রাণ কেমন হয়েছে।
সে মানুষ কোথা থাকে যাব তার কাছে।।
বলেছিল ওড়াকান্দি আসিব না আর।
আমি গিয়ে দেই তারে এই সমাচার।।
মিনতী কহিছে জানি তাহার বারতা।
গঙ্গাচন্না বাস করে শুনিয়াছি কথা।।
উপেন্দ্র চলিল সেই মানুষ খুজিতে।
জলে ভরা আখি দুটি লাগিল হাটিতে।।
কোথা সেই গঙ্গাচন্না ভাবে মনে মন।
গোপালগঞ্জে এসে দিল দরশন।।
তথা হতে টাবুরিয়া নৌকা করে নিল।
গঙ্গাচন্না যাব বলে তাহাকে বলিল।।
সে বলিল মোর বাড়ী পাটগাতী হয়।
গঙ্গাচন্না চেনা আছে শুন মহাশয়।।
উপেন্দ্র বলেছে বড় ভালই হইল।
মোরে লয়ে ওগো মাঝি গঙ্গাচন্না চল।।
যত টাকা চাও তুমি তত টাকা দিব।
গঙ্গাচন্না গিয়ে আমি ফিরিয়া আসিব।।
টাবুরিয়া বলে আমি নৌকা বেয়ে খাই।
টাকা দিলে যেথা যাবে বেয়ে নিব ভাই।।
এত বলি সেই মাঝি নৌকা ছেড়ে দিল।
ভাটি পেয়ে সেই নৌকা বেগেতে চলিল।
গঙ্গাচন্না খাল বেয়ে চলিতে লাগিল।।
অশ্বিনীর ঘাটে গিয়ে নৌকা ভিড়াইল।
নৌকা হতে সে উপেন্দ্র মাটিতে নামিয়া।।
অশ্বিনীর পদে পড়ে কহিছে কাঁদিয়া।
ওগো বাবা নিবেদন করি শ্রীচরণে।
তোমা সম হরিভক্ত নাহি এ ভুবনে।।
তোমার মুখের কথা সত্য হইয়াছে।
সাত মাস মিনতীর গর্ভ দেখা দিছে।।
উলপুর যেতে হবে চরণে জানাই।
তুমি বিনে আমাদের আর কেহ নাই।।
অশ্বিনী বলেছে আমি এখনে না যাব।
উত্তর মুখেতে আমি কভু না ফিরিব।।
তব ঘরে ছেলে হলে যাইব সেদিনে।
প্রতিজ্ঞা করেছি আমি তোমার কারণে।।
উপেন্দ্র শুনয়া তাহার চরণে পড়িল।
চরণ ধরিয়া শেষে কাঁদিতে লাগিল।।
কেঁদে বলে ওগো বাবা চরণে জানাই।
পদে যেন থাকে ভক্তি এই ভিক্ষা চাই।।
অশ্বিনী চলেছে তুমি ঘরে চলি যাও।
মিনতীকে সঙ্গে করে গুর গুণ গাও।।
তাই শুনে সে উপেন্দ্র ঘরে ফিরে গেল।
অধম বিনোদ বলে হরি হরি বল।।
******মিনতীর পুত্রের জন্ম*******
হরিচাঁদ লীলা কথা, বর্ণিবারে পারে কেতা
হরি হতে বড় হরিনাম’’
নাম হতে বড় ভক্ত, এ জগতে আছে ব্যাক্ত
ব্যাক্ত আছে এ মরত ধাম।
অধমের এ মিনতী, লিখি আজি ভক্তিগীতি
সে কেমল শ্রীহরি কৃপায়।
হরি ভক্ত কৃপা করে অশির্বাদ কর মোরে
মনবাঞ্ছা যেন পূর্ণ হয়।।
অশ্বিনীর কথা ধরে, মিনতী আসিয়া ঘরে
ভক্তি করি অশ্বিনীর পায়।
হরি হরি হরি বলে, ভাসিত নয়ন জলে
অশ্বিনীকে রাখিয়া হৃদয়।।
এইভাবে দিন গেল, দশমাস গত হল্
শুভক্ষণে জন্মিল নন্দন।
পুত্র মুখ চক্ষে হেরি, শিশুপুত্র কোলে করি
অশ্বিনীকে করিছে স্মরণ।।
বলে বাবা কোথা তুমি, বড় অভিাগিনী আমি
তোমার যে মুখের কথায়।
এল পুত্র মোর ঘরে, তুমি বাবা কৃপা করে
দেখে যাও আসিয়া হেথায়।।
এইভাবে সে মিনতী, করে কত স্তবস্ততি
প্রতিবেশী আসিল সবাই।
কেহ করে উলধ্বনী, কেহ করে জয়ধ্বনী
আনন্দের সীমা নাই।
প্রতেবেশী ছিল যারা, আনন্দেতে আত্মহারা
কেহ কেহ করে শঙ্খধ্বনী।
কেহ কেহ হরি বলে, নাচে দুই বাহু তুলে
কেহ কেহ করে হরিধ্বনী।
উপেন্দ্র ছিল না ঘরে, শহরে চাকুরী করে
একজন সংবাদ জানায়।
যখনে জানিতে পারে, পুত্র এল মোর ঘরে
আনন্দেতে আত্মহারা হয়।
একমাস ছুটি নিয়ে, আসিল ঘরে ফিরিয়ে
পুত্র মুখ করি দরশন।
হরি হরি হরি বলে, ভাসিয়া নয়ন জলে
কোলে করে আপন নন্দন।।
কোলেতে সোনার চাঁদ, মিটাইল পুত্র স্বাদ
অশ্বিনীর গায় গুণগান।
ধন্য ধন্য শ্রী অশ্বিনী, হরিভক্ত শিরমণি
আশির্বাদ কর মোরে দান।
জানিলাম ধরাতলে, হরিভক্ত কৃপা হলে
সব কিছু হয় দুনিয়ায়।
অপুত্রকে পুত্র পায়, বোবা লোকে কথা কয়
অন্ধ জনে চক্ষু পায়।।
এত ভাবি সে উপেন, গঙ্গাচন্না চলিলেন
অশ্বিনীকে আনিবারে গেল।
হরি হরি হরি বলে, ভাসি দুই আখি জলে
গঙ্গাচন্না হইল উদয়।।
অশ্বিনীর পড়ি পায়, কেঁদে গড়াগড়ি যায়
বলে বাবা চল মম ঘরে।
তোমার হয়েছে ভাই, তোমা নিতে আসি তাই
একবার দেখে এস তারে।
এই কথা শুনি কানে, আনন্দ পাইয়া মনে
বলে বাবা চল শ্রীঘ্র যাই।
রাখিতে ভক্তের মান্য, হরিচাঁদ অবতীর্ণ
তাই দেখে পরান জুড়াই।।
মুখে হরি হরি বলে, দুই জনে দ্রুত চলে
উলপুর হইল উদয়।
ছোট্ট শিশু কোলে করি, মুখে বলি হরি হরি
আনন্দেতে নাচিয়া বেড়ায়।।
আনন্দতে আত্মহারা, প্রেম রসে তনু পোরা
সে ছেলের হস্ত দিয়া গায়।
হাসি মাখা বদনেতে, ছলছল নয়নেতে
হরি বলে আশির্বাদ দেয়।।
মিনতী চরণ ধরি, কেদে যায় গড়াগড়ি
বলে বাবা বলি যে তোমায়।
আমার মনের ব্যাথা, ঘুচাইলে ওগো পিতা
পুত্র পাই তোমার কথায়।।
ভক্তি নাই জ্ঞান নাই, বিভাবে পুজিব তাই
তব যুগল চরণ খান।
নিজ গুনে কৃপা করে, আশির্বাদ কর মোরে
জুড়াইব এ তাপিত প্রাণ।।
মিনতীর শুনে বাণী, কহিলেন সে অশ্বিনী
শুন মাগো তোমাকে জানাই।
ছয় মাস হলে পরে, তব পুত্র কোলে করে
যেতে হবে গুরুচাঁদ ঠাই।।
গুরুচাঁদ গুণমনী, আশীর্বাদ দিবে তিনি
তাহলেই মঙ্গল হইবে।
আমি এবে যাই ঘরে, আবার আসিব পরে
দিবানিশি হরি গুণ গাবে।।
এত বলি সে অশ্বিনী, গঙ্গাচন্না চলে তিনি
হরি হরি মুখেতে বলিয়া।
এইভাবে দিন গেল, ছয় মাস গত হলো
উলপুর আসিল চলিয়া।।
মিনতী চোখেতে হেরি, পদে যায় গড়াগড়ি
কেদ কেদে চরণ দোয়ায়।
উপেন্দ্র বাড়ীতে ছিল, তিনি এসে পদে পল
পদধূলী লইল মাথায়।।
তারপর সে মিনতী, রন্ধন করিয়া সতী
অশ্বিনীকে ভোজন করাল।
তারপর সবে মিলে, মুখে হরি হরি বলে
ওড়াকান্দি গমন করিল।।
মিনতীর পুত্র কোলে, অশ্বিনীর পিছে চলে
উপেন্দ্র সে চলে সাথে সাথে।
হরি হরি হরি বলে, ভাসিছে নয়ন জলে
এইভাবে লাগিল হাটিতে।।
অশ্বিনী প্রেমের সুরে, সদা হরিনাম করে
প্রেম রসে মাখা তনু মন।
এইভাবে কাদি কাদি, উতরিল ওড়াকান্দি
গদি ঘরে উঠিল তখন।।
সাজায়ে ভক্তের মেলা, গুরুচাঁদ করে খেলা
মাঝাখানে সবে গুরুচাঁদ।
চারিদিকে ভক্তসব, করোজো কের স্তব
ঠিক যেন আকাশের চাঁদ।।
গুরুচাঁদ শ্রীচরণে, রাখিয়া সে পুত্র ধনে
মিনতী কেদে কেদে কয়।।
আমি বড় অপরাধী, তুমি মোর গুণনিধি
মম পুত্র রেখ রাঙ্গা পায়।।
হও তুমি দয়াবান, পুত্রে কর প্রাণ দান
দীর্ঘজীবি হয়ে যেন রয়।
গুরুচাঁদ দেখে চেয়ে, আসিয়াছে সেই মেয়ে
বন্ধা বলে ছিল এ ধরায়।।
আমি দিনু ফিরাইয়ে, অশ্বিনীর কথা নিয়ে
পুত্র পেল অশ্বিনী কৃপায়।
সেই পুত্র কোলে, গুরুচাঁদ কেদে বলে
ভক্তগন ডেকে ডেকে কয়।।
হরি হতে নাম বড়, নাম হতে ভক্ত বড়
এ জগতে রহিল প্রমাণ।।
সেই ছেলে বুকে ধরে, আশীর্বাদ করে শিরে
মুখে করে হরি গুণগান।।
তাই দেখে ভক্তগণে, পড়িলেন শ্রীচরণে
কেদে কেদে চরণ ধোয়ায়।
গুরুচাঁদ ডেকে বলে, ধর মাতা তব ছেলে
কোলে কর তোমার তনয়।।
পুত্র নিয়ে সে মিনতী, ভক্তগণ পদে নতী
করিতেছে কাদিয়া কাদিয়া।।
ভক্তগনে হরি বলে, নাচে দুই বাহু তুলে
কেহ কাঁদে গড়াগড়ি দিয়া।।
প্রেমনিধি হয়ে ক্ষান্ত, গুরুচাঁদ হলে শান্ত
ভক্তগনে ডেকে ডেকে কয়।
গুণ গুণ ভক্তগণ, করি এই নিবেদন
পদধুলি দাওহে আমায়।।
তাই শুনে ভক্তগণ, করে সবে পলায়ন
গদিঘর শূণ্য হয়ে গেল।
শুধু আছে সে অশ্বিনী, হরিভক্ত শিরমনী
হেন দৃশ্য দেখিবারে পেল।।
গুরুচাঁদ চোখে জল, করিতেছে টলমল
মুখে শুধু বলে হরি বল।।
অশ্বিনী কহিছে বাবা, পদধুলি কত নিবা
কেন তুমি হয়েছ দুর্বল।।
তুমি যদি সুখে রও, পদধুলি কত চাও
দরকার যত তব লও।
তোমা করি আশির্বাদ, পোরে যেন মনসাদ
তুমি যাতে সুখী হয়ে রও।।
তুমি প্রভু থাক সুখে, আমি যেন কাদি দুখে
তব কাছে এই ভাক্ষি চাই।
হরিনাম করি সার, ভব নদী হব পার
মাঝি রূপে তোমা যেন পাই।।
গুরুচাঁদ বলে হরি, অশ্বিনীকে বুকে ধরি
কেদে কেদে গড়াগড়ি যায়।
কেহ দেয় হুলুধ্বনী, কেহ দেয় হরিধ্বনী
সবে এসে পড়িল ধরায়।।
বহু পরে হল শান্ত, প্রেমনিধি হলে ক্ষান্ত
ভক্তি করি গুরুচাঁদ পায়।
হরি হরি হরি বলে, যার যার ঘরে চলে
আনন্দেতে হরি গুণ গায়।।
হরি হতে নাম বড়, নাম হতে ভক্ত বড়
এই যুগে দেখিবারে পাই।
কান্দিয়া বিনোদ বলে, এ জনম গেল চলে
হরি হরি বল সবে ভাই।।
******কৃষ্ণ বেপারীর কাহিনী*******
খুলনা জেলা
মধ্যে চিতলমারী থানা।
চল বানীয়ারী গ্রাম সকলের জানা।।
সেই গ্রামে বাস করে শ্রীকৃষ্ণ বেপারী।
অশ্বিনীর প্রিয় ভক্ত সদা বলে হরি।।
অশ্বিনীর চরণেতে দৃঢ় ভক্তি তার।
মন প্রাণ সপে দিয়ে হল নির্বিকার।।
একদিন সে অশ্বিনী ঘুরিতে ঘুরিতে।
উদয় হইল গিয়া কৃষ্ণের বাড়িতে।।
হরি বলে যখনেতে বাড়িতে উঠিল।
কৃষ্ণের রমনী এসে চরণে পড়িল।।
কেদে কেদে সেই নারী চরণ ধোয়ায়।
আসন পাতিয়া শেষে বসিবারে দেয়।।
ধুপ ধুনা দিযে সে যে হুলুধ্বনী করে।
কৃষ্ণ আসিয়া গুরুর চরণেতে পড়ে।।
যুগল চরণ ধরি কাদিতে লাগিল।
তার নারী পাখা দিয়ে বাতাস করিল।।
সংবাদ পাইয়া এল আরো দুইজন।
ভাষারাম ঠেট আর শ্রীগুরু চরণ।।
তারা এসে দুইজনে প্রণাম করিল।
আহারাও অশ্বিনীর অনুগত ছিল।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেছে তার রমনী ঠাই।
কিবা খেতে দিবা আমি তোমাকে শুধাই।।
তার নারী ব্যস্ত হয়ে গৃহ মধ্যে যায়।
ঘরে আছে পাকা পেপে দেখিবারে পায়।।
বৈশাখ মাসের শেষ পাকা আম আছে।
তাই নিয়ে সে রমনী বাহিরে এসেছে।।
ফল কেটে খেতে দিল অশ্বিনীর ঠাই।
পরাণ ভরিয়া খেল অশ্বিনী গোসাই।।
তারপর তিন জনে একখানে বসে।
মাছ ধরিবারে যাবে করে পরামিশে।।
তাই জেনে সে অশ্বিনী বলিল বচন।
কোন মাছ ধরিবারে করিয়াছ মন।।
তাহারা বলেছে সবে অশ্বিনীর ঠাই।
যেই মাছ খেতে চাও এনে দিব তাই।।
অশ্বিনী বলেছে আমি আড় মাছ চাই।
পার যদি সবে মিলে এনে দাও তাই।।
তাই শুনে তিন জন করিল গমন।
জুতি হাতে চলেলেন শ্রীগুরু চরণ।।
নদীতে যাইয়া সবে নৌকায় উঠিল।
দশ হাত নৌকা বেয়ে কিছুদুর গেল।।
বৈশাখ মাসে নদীর জল কমে যায়।
অল্প জলে আড় মাছে গর্ত করে রয়।।
পাঙ্গান বলিয়া তারে জনগণ কয়।
জলে নেমে খোজ করে গোজ গেড়ে দেয়।।
একুশটি গর্তে সেই ঠিক করা আছে।
নৌকা বেয়ে তিন জনে তার কাছে গেছে।।
আগানায় জুতি হাতে শ্রীগুরু চরণ।
মাঝখানে বসে আছে সেই কৃষ্ণধন।।
পাছানায় বসে সেই ভাষারাম ঠেটা।
আস্তে আস্তে নাও বায় হাতে নিয়ে বৈঠা।।
একে একে কুড়িখানা পাঙনে কোপায়।
খালি জুতি উঠে আসে মাছ নহে পায়।।
শ্রীকৃষ্ণ বেপারী কহে এক কোপ বাকি।
এ কোপেও যদি ভাই হয়ে যায় ফাকি।।
গোসাই বলেছে আমি আড় মাছ খাব।
সেই মাছ যদি আজ দিতে না পারিব।।
জীবন ত্যাজীব আজি শুন ওরে ভাই।
শ্রীগুরু চরণ বলে মোর কথাই তাই।।
এই কোপে মাছ যদি মিলাতে নারিব।
এ নৌকা ডুবায়ে দিয়ে সকলে মরিব।।
এত বলি তিন জন প্রতিজ্ঞা করিয়া।
নৌকা সঙ্গে দড়ি বাধে গুরুকে স্মরিয়া।।
সে গুরুচরণ দড়ি বাধিলেন পায়।
কৃষ্ণ বেপারী সে বাধিল মাজায়।।
ভাষারাম বাধে দড়ি নিজের গলায়।
অনুরাগে তিনজন মরিবারে চায়।।
গুরুকে স্মরণ করি শেষ কোপ দিল।
এক বড় আড় মাছ সে কোপে বিধিল।।
তাই দেখে সকলের আনন্দিত মন।
তারপর খুলে ফেলে সবার বান্ধন।।
মাছ নিযে তিন জন বাড়ীতে আসিল।
অশ্বিনী তখন ওঠে রওনা হইল।।
কারে কিছু না বলিয়া দ্রুতগতি ধায়।
কৃষ্ণের রমনী গিয়ে ধরিলেন পায়।।
অশ্বিনীর পদ ধরি সে রমনী বলে।
কোন অপরাধ পেয়ে মোরে যাও ফেলে।।
যদি কোন অপরাধ করে থাকি বাবা।
অভাগিনী অবলারে ক্ষমা করে দিবা।।
সাধন না জানি বাবা ভজন না জানি।
নিজ গুনে কৃপা কর ওহে গুণমনী।।
অশ্বিনী বলেছে মাগো শুন মোর কথা।
দড়ি দিয়ে বাধে মোরে তাই পাই ব্যাথা।।
তিন জনে তিন স্থানে আমাকে বেধেছে।
চেয়ে দেখ সেই খানে ফুলিয়া রয়েছে।।
গলদেশে ফুলিয়াছে বন্ধন জ্বালায়।
কোমরে হয়েছে দাগ দেখ মোর গায়।।
পায়েতে বাধিল মোরে চেয়ে দেখ তাই।
বল মাগো এই ব্যাথা কোথায় জুড়াই।।
তাই দেখে তিনজনে চরনে পড়িল।
চরণ ধরিয়া শেষে কাদিতে লাগিল।।
নয়নের জলে ভেসে কেদে কেদে কয়।
তোমার চরণ বিনে দাড়াব কোথায়।।
ক্ষমা কর অপরাধ মাগি পরিহার।
তোমার নফর মোরা এ দেহ তোমার।।
কান্না দেখে অশ্বিনীর দয়া উপজিল।
সকলকে নিয়ে শেষে গৃহ মধ্যে গেল।।
আড় মাছ খেতে দিল রন্ধন করিয়া।
অশ্বিনী খাইল তাহা পরাণ ভরিয়া।।
অধম বিনোদ বলে বেলা বেশি নাই।
অশ্বিনীর প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।
******পূর্ণচন্দ্রের
কাহিনী*******
খুলনা জেলায়
আছে শুড়িগাতী গ্রাম।
সেই গ্রামে বাস করে পূর্ণচন্দ্র নাম।।
অশ্বিনীর প্রিয় ভক্ত সরল হৃদয়।
অশ্বিনীর গুণগান গাহিয়া বেড়ায়।।
হরি হরি বলে মুখে ওড়াকান্দি যায়।
গুরুচাঁদ চরণেতে প্রণাম জানায়।।
গুরুচাঁদ আশীর্বাদ করিয়া গ্রহণ।
অশ্বিনীর পিছে পিছে চলে সর্ব্বক্ষণ।।
কিছুদিন অশ্বিনীর সঙ্গেতে ঘুরিয়া।
পুনরায় আসিলেন ঘরেতে ফিরিয়া।।
সংসারী সাজিয়া সদা করিতেন কর্ম।
হাতে কাম মুখে না এ যুগের ধর্ম।।
এই ভাবে চলিতেন ভকত সুজন।
হরিনাম করিবারে ঝরে দুনয়ন।।
এইভাবে কতদিন গত হয়ে গেল।
দৈবের ঘটনা তাহা কে খন্ডাবে বল।।
একদিন সেই গ্রামে গন্ডগোল হয়।
দুই দলে মারামারি করিল সবায়।।
সেইখানে পূর্ণচন্দ্র ঠেকাইতে গেল।
ঠেকাইতে গিয়ে তিনি আসামী হইল।।
বিপক্ষেরা কেস করে যাইয়া থানায়।
আসামীর পক্ষ তারা পালাইয়া ভয়।।
পূর্ণচন্দ্র নির্ভয়েতে ঘরেতে রহিল।
আসামী হয়েছে তিনি কিছু না জানিল।।
একদিন সে অশ্বিনী বলে হরি হরি।
উদয় হইল এসে সেই বালা বাড়ী।।
অশ্বিনীকে দেখে সেই পূর্ণচন্দ্র বালা।
আনন্দেতে আত্মহারা হইল বিভোলা।।
অশ্বিনী চরণে গিয়ে প্রণাম করিল।
ছল ছল আখি দুটি কহিতে লাগিল।।
এই বাড়ী এই ঘর সকল তোমার।
তোমার চরণে আমি করি পরিহার।।
বাড়ীর সবাই এসে প্রণাম করিল।
চরণ ধোয়ায়ে শেষে ঘরেতে বসাল।।
হুলুধ্বনী হরিধ্বনী করে সবে মিলে।
ধুপ ধুনা দিয়ে শেষে ভাসে আখি জলে।।
এইভাবে ভক্তি করে ভোজন করাল।
তারপরে সবে মিলে প্রসাদ খাইল।।
হরি বলে সে অশ্বিনী শয়ন করিল।
সেই দিন সেই রাত্রি তথায় রহিল।।
ভোরবেলা পূর্ণচন্দ্র ঘুম থেকে জাগি।
বারান্দায় বসিলেন হুকা সেবা লাগি।।
হেনকালে থানা হতে দারোগা আসিল।
পুলিশ সঙ্গেতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করিল।।
পূর্ণচন্দ্র বালা নামে সে বাড়ী কোথায়।
বাড়ী আছে কি না আছে কহে মহাশয়।।
পূর্ণচন্দ্র বলে এই তার বাড়ী হয়।
মম নাম পূর্ণচন্দ্র দিনু পরিচয়।।
দারোগা বলেছে তুমি আসামী হয়েছে।
আগে পরে তাহা তুমি কখন জেনেছ।।
থানা হতে আসিয়াছি তোমাকে ধরিতে।
হুকুম আছে মোদের হাত কড়া দিতে।।
ঘর থেকে নেমে এস করিব বন্ধন।
থানাতে লইয়া যাব তোমারে এখন।।
তাই শুনে পূর্ণচন্দ্র কি যেন ভাবিয়া।
অশ্বিনীর পদপ্রান্তে কহিছে কাদিয়া।।
শুন শুন ওগো বাবা করি নিবেদন।
আসামী হয়েছি আমি বড় অভাজন।।
মারামারি গন্ডগোল আমি করি নাই।
আসামী হয়েছি কেন বল আজি তাই।।
তাই শুনি সে অশ্বিনী বাহিরেতে এল।
দারোগার কাছে এসে কহিতে লাগিল।।
থানা হতে আসিয়াছে রিপোর্ট পাইয়া।
এই আসামীর নাম শুনাও পড়িয়া।।
দারোগা সেই খাতা ধরে দেখাতে লাগিল।
পূর্ণচন্দ্র নাম কভু খুজিয়া না পেল।।
বার বার সেই খাতা করে অন্বেষণ।
তাই দেখে দারোগা সে ভাবে মনে মন।।
অশ্বিনীর মুখপানে দারোগা চাহিয়া।
কি যেন ভাবিয়া কাঁদে চরণে পড়িয়া।।
অপরাধ করিয়াছি কেদে কেদে কয়।
ক্ষমা কর অপরাধ ওগো মহাশয়।।
অশ্বিনী বলেছে বাবু সুস্থ কর মন।
ঈশ্বর ইচ্ছায় হয় এসব ঘটন।।
তাই শুনি সে দারোগা সকলকে নিয়া।
থানায় চলিল সবে বিদায় হইয়া।।
তাই দেখে সকলেতে মানিল বিস্ময়।
অশ্বিনীর চরণেতে গড়াগড়ি যায়।।
অধম বিনোদ বলে আর কিবা চাও।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি গুণ গাও।।
******শীতলের গুরুভক্তি*******
গোড়ানালুয়া গ্রামেতে নামেতে শীতল।
হরিভক্ত শিরমণী বলে হরি বল।।
বাড়ই বংশেতে জন্ম হইল তাহার।
অশ্বিনীকে ভালবাসে নির্ম্মল অন্তর।।
অশ্বিনীর গুণকথা বলিতে বলিতে।
ঝর ঝর আখি দুটি লাগিত ঝরিতে।।
মাঝে মাঝে সে অশ্বিনী সে বাড়ী যাইত।
পরিবার সহ এসে পদেতে পড়ি।।
ভক্তি করে অশ্বিনীকে করাত ভোজন।
সেবাতে হইত তুষ্ট অকতের মন।।
শীতলের মন ছিল অতীব সরল।
অশ্বিনীকে কাছে পেল ঝরে আখিজল।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ নামেতে মাতিয়া।
অশ্বিনীকে ভালবাসে মন প্রাণ দিয়া।।
যে সময় যেই ফল গাছেতে পাকিত।
অশ্বিনীকে আগে দিয়ে পরে সে খাইত।।
একদিন তার গাছে পেঁপে পেকেছিল।
অশ্বিনীকে খেতে দিয়ে মনেতে ভাবিল।।
দুই দিন পরে তাহা গেল ভুলিয়া।
পাঁচদিন পরে সেই অশ্বিনী সুজন।।
শীতলের বাড়ী এসে দিল দরশন।
শীতলের নারী এসে ধোয়াল চরণ।।
শীতল আসিয়া করে চরণ বন্দন।
চরণ ধোয়ায়ে শেষে আসনে বসাল।।
চিড়ামুড়ি খেতে দিবে জোগাড় করিল।
মুড়ি না খাইব আমি বলেছে গোসাই।
পাকা ফল খাব আমি এনে দেও তাই।।
তাই শুনি সে শীতল কেঁদে ছাড়ে হাই।
পাকা পেঁপে ঘরে আছে মোর মনে নাই।।
তোমাকে খাওব বলে ঘরেতে রেখেছি।
মন বড় দুরাচার ভুলিয়া গিয়েছি।।
এত বলি তার নারী গৃহ মধ্যে যায়।
পাকা পেঁপে এনে দিল অশ্বিনী সেবায়।
ফল খেয়ে বলেছেন অশ্বিনী গোসাই।।
তোমাদের দেয়া ফল বড় ভাল খাই।।
তারপর সে রমনী পাক ঘরে গেল।
হরিভক্ত সেবা লাগি রন্ধন করিল।।
গুরুকে করায় সেবা হরি বলে মুখে।
অশ্বিনী করেন সেবা পরম কৌতুকে।।
সেবা করি সে অশ্বিনী বিশ্রাম করিল।
পিঠা তৈরী করিবারে প্রস্তুত হইল।।
আলো চাল ভিজাইয়া আনিল যখন।
তখন অশ্বিনী উঠে করিল গমন।।
তাই দেখে কাঁদিতেছে শীতলের নারী।
অশ্বিনী চরণে পড়ে যায় গড়াগড়ি।।
অশ্বিনী বলেছে মাগো শুন দিয়া মন।
গুড়িগাতী উৎসবে যাইব এখন।।
সেইখানে দিয়ে মাগো অদ্য নিশি রব।
ফিরিবার পথে তব পিঠে খেয়ে যাব।।
এত বলি সে অশ্বিনী করিল গমন।
তাই শুনি সকলের আনন্দিত মন।।
তারপর চাল কুটি পিঠা যে করিল।
খেজুরের রস দ্বারা পিঠা ভিজাইল।।
সেই পিঠা হড়ি করি সরা চাপা দিয়া।
রাখিলেন যত্ন করি ঘরেতে তুলিয়া।।
আর যত পিঠা ছিল ছেলে মেয়ে খেল।
স্বামী সনে তার নারী পিঠে না খাইল।।
আজ আসে কাল আসে মনেতে ভাবিল।
এইভাবে সাত দিন গত হয়ে গেল।।
সাতদিন পরে সেই অশ্বিনী সুজন।
শীতলের বাড়ী এসে দিল দরশন।।
শীতলের নারী আর শীতল আসিয়া।
কাঁদিতে লাগিল তারা পদেতে পড়িয়া।।
কেঁদে বলে ওগো বাবা বলি তব ঠাই।
পদে যেন থাকে ভক্তি এই ভিক্ষা চাই।।
শীতল কহিছে তার নারীর নিকটে।
পুনরায় চাল কুটি করে দাও পিঠে।।
তাই শুনি সে অশ্বিনী কহিতে লাগিল।
ঘরে আছে ভিজে পিঠি তাই খাব ভাল।।
তাই শুনি তার নারী গৃহ মধ্যে যায়।
ভিজান পিঠার হাড়ি আনিল তথায়।।
হাড়ি খুলে খেতে দিল অশ্বিনীর ঠাই।
পরাণ ভরিয়া খেল অশ্বিনী গোসাই।।
অশ্বিনীর সঙ্গে যত ভক্তগন ছিল।
যেমন টাটকা পিঠা তেমন খাই।।
অধম বিনোদ বলে আর কিবা চাও।
অশ্বিনীর প্রীতে সবে হরি গুণ গাও।।
******মতির
ঘটনা*******
সত্যবাদী
জিতেন্দ্রিয় অশ্বিনী সুজন।
হরিনাম করিবারে ঝরে দুনয়ন।।
হরিচাঁদ গুনগান রচনা করিয়া।
ভক্তগন মাছে তাহা বেড়ায গাহিয়া।।
নিজের রচনা পদ নিজে সুরকার।
শুনিয়া সবার চোখে বহে প্রেমধার।।
মতি নামে একজন দারখালী বাড়ী।
অশ্বিনীর সঙ্গে ঘোরে বলে হরি হরি।।
কন্ঠস্বর ছিল তার অতি মধুময়।
গান শুনে সব লোকে মানিতে বিস্ময়।।
সে অশ্বিনী যত গান রচনা করিল।
সব গান সেই মতি গাহিয়া চলিল।।
অশ্বিনীর ভালবাসা সে মতি পাইয়া।
অশ্বিনীর সাথে সাথে বেড়ায় ঘুরিয়া।।
অশ্বিনীর এক মেয়ে বিমলা নামেতে।
চেহারায় কৃষ্ণা বর্ণা নিয়ম দেখিতে।।
একদিন বলিলেন অশ্বিনী গোসাই।
শুন শুন শুন মতি তোমাকে জানাই।।
মোর মনে এক ইচ্ছা জাগে সর্বক্ষণ।
তুমি মোর সেই ইচ্ছা করহে পূরণ।।
তুমি মোর বিমলাকে বিবাহ করিবে।
আমার মনের বাঞ্ছা তবে পূর্ণ হবে।।
এই কথা শুনি মতি মনে মনে কয়।
কাল মেয়ে বলে তার ইচ্ছা নাহি হয়।।
প্রকাশ্যে বলেছে তাই অশ্বিনীর ঠাই।
আমার মনের কথা তোমাকে জানাই।।
বিবাহ করিতে মোর হয়নি সময়।
অন্য পাত্রে কন্যা দান কর মহাশয়।।
অশ্বিনী বলেছে মতি কি কথা বলিলে।
কাল মেয়ে বলে তুমি অবজ্ঞা করিলে।।
শুন বলি ওগো মতি, বলি যে তোমায়।
বিবাহ করিতে তব হবে না সময়।।
এই কথা যখনেতে অশ্বিনী বলিল।
মনে মনে সেই মতি ভাবিতে লাগিল।।
আমার মনের কথা জানিতে পারিয়া।
অভিশাপ দিল মোরে কি যেন ভাবিয়া।।
তারপর সেই মতি গৃহেতে চলিল।
এইভাবে কত দিন গত হয়ে গেল।।
অশ্বিনীর লীলা সাঙ্গ যখনে হইল।
তারপর সেই মতি মেয়ে দেখে এল।
দিন ধার্য্য সব কিছু ঠিক হয়ে গেল।।
বিবাহের দিন মাত্র একদিন আছে।
সর্পঘাতে সে মেয়ের মরণ হয়েছে।।
তারপর কিছুদিন গত হয়ে যায়।
বিবাহ করিতে তার জাগিল হৃদয়।।
অনেক দেখিল মেয়ে বিবাহ না হয়।
যেইখানে যায় তথা বাধা পেয়ে যায়।।
একবার কালশিরা গ্রামেতে চলিল।
মেয়ে দেখে বিবাহের দিন ঠিক হল।।
বিবাহ করিতে যাবে এমন সময়।
কলেরায় সে মতি হল মৃত্যুপ্রায়।।
এইভাবে সে মতির বিয়া না হইল।
বিবাহের আশা মতি শেষ ছেড়ে দিল।।
অশ্বিনীর কথা যেই মনেতে পড়িত।
নির্জনে বসিয়া মতি তখনে কাঁদিত।।
অশ্বিনীর ছবিখানি হৃদয় ধরিয়া।
উদাসীন সেই মতি বেড়াত ঘুরিয়া।।
অধম বিনোদ বলে বেলা বেশি নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।
******তীর্থ
ভ্রমণ ও মানব লীলা সম্বরণ*******
একদিন সে
অশ্বিনী ভাবে মনে মনে।
সংসার বন্ধন আমি এড়াব কখন।।
এ সংসারে পুত্র কন্যা কেহ কারো নয়।
মায়ামহ ধুলা খেলা শুধু অভিনয়।।
অসার ভেবেছি সব হরি নাম সার।
যাহা দ্বারা হতে হবে ভবসিন্ধু পার।।
তাই ভবে সে অশ্বিনী করেছে চিন্তন।
হেনকালে তার নারী দিল দরশন।।
মালঞ্চ বলেছে তার স্বামীর নিকটে।
ছল ছল আখি দুটি কহে করপুটে।।
দিবানিশি হরিগুণ গাহিয়া বেড়াও।
আমার মনের বাঞ্ছা তুমি হে পুরাও।।
রিতুবতী হইয়াছি রতি কর দান।
যদি কথা না রাখিবে তেজিব পরাণ।।
এক কন্যা জন্মিয়াছে তোমার ঔরসে।
এক পুত্র চাই আমি তোমার সকাশে।।
হেন বাক্য যখনেতে অশ্বিনী শুনিল।
মনে মেন সে অশ্বিনী ভাবিতে লাগিল।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ।
সে নিশি বঞ্চিল সেই নারীর কারণ।।
মনে ছিল পিতৃধন করিব যতন।
তাহা না হইল আমি নারীর কারণ।।
বিরহেতে দহিতেছে সাকরে হিয়া।
হরি হরি বলে সদা বেড়ায় কাঁদিয়া্।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ, করিয়া স্মরণ।
গৃহ হতে সে অশ্বিনী করিল গমন।।
মহানন্দ ছবিখানি রাখিয়া মনেতে।
ছল ছল আখি দুটি লাগিল হাটিতে।।
অনাহারে থাকি সদা হরি গুণ গায়।
এইভাবে হরিভক্ত পথ চলি যায়।।
ঘোর অন্ধকার হল নদীর কিনারে।
জনহীন নদীতটে ভাসে আখি নীরে।।
আঠার বাকি নদীতে খরস্রোত বয়।
রাত্রিবেলা বসে কাঁদে তার কিনারায়।।
পার হয়ে যাবে নদী ভাবে মনে মন।
নৌকা নাই পারে যেতে কি করি এখন।।
হরি বলে কাঁদিতেছে প্রেমিক অশ্বিনী।
নাম শুনে ভেসে ওঠে এক কুম্ভিরীনী।।
তাই দেখে সে অশ্বিনী ঝাপ দিয়া পল।
হরি ভক্ত কাছে পেয়ে পৃষ্ঠেতে করিল।।
কুম্ভিরীনী হরিভক্ত পৃষ্ঠেতে করিয়া।
আখি জলে ভাসিতেছে জলেতে ভাসিয়া।।
ধীরে ধীরে কুম্ভিরীনী চলিতে লাগিল।
পৃষ্ঠে বসে সে অশ্বিনী মনেতে ভাবিল।।
এমন বন্ধন মোর আছে এ জগতে।
জলের কুম্ভির পার করেছে নদীতে।।
হরি বলে সে অশ্বিনী কাঁদিতে লাগিল।
মহাভাবে মহারত্ন জ্ঞান হারাইল।।
কুম্ভিরীনী আনন্দেতে ওপারেতে গেল।
অশ্বিনীকে কুলে রেখে জলেতে লুকাল।।
এইভাবে সে অশ্বিনী অচৈতন্য হয়ে।
সারানিশি নদীকুলে রহিলেন শুয়ে।।
যখনেতে হরিভক্ত উদয় হইল।
তখনেতে হরিভক্ত চৈতন্য পাইল।।
হরি বলে মহারত্ন করিল গমন।
প্রেমে গদগদ চিত্ত ঝরে দুনয়ন।।
পশ্চিম দিকেতে চলে বলে হরি হরি।
সন্ধ্যাবেলা উপনীত গিয়ে এক বাড়ী।।
জঙ্গলের মধ্যে সেই বাড়ীখানি হয়।
লোকজন কিছু নাই কি হবে উপায়।।
সেই ঘরে উঠিলেন অশ্বিনী গোসাই।
বসিবার স্থান আছে দেখিলেন তাই।।
সেই খানে বসিলেন হরি হরি বলে।
প্রেমেতে মাতিয়া রত্ন ভাসে আখি জলে।।
ক্ষুধায় কাতর হয়ে চারিদিকে চায়।
খাদ্য নিয়ে এক মেয়ে আসিল তথায়।।
খাদ্য বস্তু রেখে তথা সেই মেয়ে কয়।
তুমি বাবা হরিভক্ত বলি যে তোমায়।।
এই বনমাঝে মোরা থাকি দুইজন।
হরিভক্ত পেলে হই আনন্দিত মন।।
খাও বাবা হরিভক্ত এখানে থাকিয়া।
মম স্বামী কাছে যাই সেবার লাগিয়া।।
এত বলি সেই মেয়ে করিল গমন।
অশ্বিনী বসিয়া তথা করিল ভোজন।।
ভোজনান্তে সে অশ্বিনী শয়ন করিল।
ঘুমে অচেতন হয়ে তথায় বঞ্চিল।।
ভোরবেলা জেগে দেখে অশ্বিনী গোসাই।
সেইখানে ঘরবাড়ী কিছুইত নাই।।
মনে মেন সে অশ্বিনী কহিতে লাগিল।
তব লীলা গুরুচাঁদ বোঝে কেবা বল।।
ভকত হৃদিরঞ্জন করুনা নিদান।
তব লীলা বুঝিবারে নাহি মোর জ্ঞান।।
আমি বড় অভাজন এই দুনিয়ায়।
অপরাধ ক্ষমা করে রেখ রাঙ্গা পায়।।
ভক্তের পিছনে তুমি বেড়াও ঘুরিয়া।
আহার যোগায়ে ফের ভক্তের লাগিয়া।।
হরি বলে সে অশ্বিনী লাগিল কাঁদিতে।
জলে ভরা আখি দুটি লাগিল হাটিতে।।
এইভাবে পদব্রজে করিল গমন।
কাশি কাঞ্চি বৃন্দাবন করেছে ভ্রমণ।।
বহুদিন ঘুরে ঘুরে চলিতে লাগিল।
তারপর সে অশ্বিনী হরিদ্বার গেল।।
হরিদ্বারে বসে তার পিপাসা জাগিল।
তামাক খাইতে ইচ্ছা তখন হইল।।
মনে তার ইচ্ছা হল হুকা খাইবার।
বৃক্ষ তলে বসে বসে চিন্তা করে তার।।
হেনকালে এক ছেলে কোথা হতে এল।
তামাক সাজিয়া হুকা অশ্বিনীকে দিল।।
হুকা ধরি প্রাণ ভরি তামাক খাইল।
কিছু পরে সে বালক অদৃশ্য হইল।।
তাই জেনে হরিভক্ত কাঁদিয়া কহিল।
নয়নের জলে বক্ষ ভাসিতে লাগিল।।
তুমি প্রভু হরিচাঁদ কাঁদিয়া কহিল।
নয়নের জলে বক্ষ ভাসিতে লাগিল।।
তুমি প্রভু হরিচাঁদ বড় দয়াময়।
জানিয়া ভক্তের মন আসিলে হেথায়।।
জেনে মন ভগবান হুকটি সাজিয়া।
বালকের রূপে প্রভু গেলে হাতে দিয়া।।
চাকরেতে হেন কাজ করেনা কথন।
মনে জেনে তাই প্রভু দিলে দরশন।।
ভকত হৃদিরঞ্জন দয়াময় হরি।
ভক্তের হইয়া ভৃত্য কর্ম্ম যাও করি।।
কি দিব তুলনা তব ওগো দয়াময়।
দয়া করি অধমেরে রেখ রাঙ্গা পায়।।
মহাভাবে আত্মভোলা অশ্বিনী গোসাই।
হরি বলে দিবা নিশি ছাড়িতেন হাই।।
উদাসীন হরি ভক্ত হাটিতে লাগিল।
পায়েতে আঘাত লেগে মাটিতে পড়িল।।
আঘাত লাগিয়া পায় ক্ষত হয়ে গেল।
অতি কষ্টে হেটে হেটে নবদ্বীপে এল।।
মন্দিরেতে যে ঘটনা হইল সেথায়।
সেই সব লেখা আছে চরিত্র সুধায়।।
তারপর সে অশ্বিনী দেশে ফিরে এল।
শুড়িগাতী বালাবাড়ী উদয় হইল।।
পূর্ণচন্দ্র বালা অশ্বিনীর ভক্ত।
সেই বাড়ী গিয়ে তিনি হল উপনীত।।
দেখিয়া সে পূর্নচন্দ্র কাদিয়া উঠিল।
বহুদিন পরে গুরু দরশন হল।।
অশ্বিনীর দেহখানি অতি কৃশকায়।
তাই দেখে পূর্ণচন্দ্র কেঁদে কেঁদে কয়।।
শুন বাবা বলি তোমা ধরি তব পায়।
আমাদের ছেড়ে তুমি যেও না কোথায়।।
যত্ন করি অশ্বিনীকে ভোজন করাল।
তিন চারদিন সেই বালা বাড়ী রল।।
একদিন কহিলেন অশ্বিনী গোসাই।
শুন তুমি পূর্ণচন্দ্র বলি তব ঠাই।।
বহুদিন হেরিনাক মায়ের চরণ।
মম সঙ্গে চল তুমি করি দরশন।।
তাই শুনি পূর্ণচন্দ্র তরণী সাজাল।
নৌকাযোগে গঙ্গাচন্না উদয় হইল।।
নৌকা মধ্যে বসে আছে অশ্বিনী গোসাই।
তাই শুনে আসিলেন বাড়ীর সবাই।।
পুলিন বিপিন তারা বিমাতা নন্দন।
অশ্বিনীর মাতা এর করিয়া ক্রন্দন।।
মায়ের কোলেতে আছে অশ্বিনীর ছেলে।
অমূল্যকে কোলে করে ভাসে আখিজলে।।
তাই দেখে সে অশ্বিনী কুলেতে নামিল।
মায়ের চরণ ধরি কাঁদিতে লাগিল।।
কেঁদে বলে ওগো মাতা বলি তব ঠাই।
বিদায় করহে মাগো শ্রীধামেতে যাই।।
পুলিন বিপিন এসে প্রণাম করিল।
হরি বলে সে অশ্বিনী আশির্বাদ দিল।।
সকলেতে সুখে রও গৃহেতে থাকিয়া।
আমি ভাই চলে যাই বিদায় হইয়া।।
নয়নে হেরিয়া সেই আপন নন্দন।
মনবাঞ্ছা পুর্ণ হলে ঝরে দুনয়ন।।
কাঁদিতে কাঁদিতে তিনি নৌকায় উঠিল।
অমনি সে পূর্নচন্দ্র তরনী ভাসাল।।
পুনরায় শুড়িগাতী আসিলেন বেয়ে।
নৌকা হতে বালা বাড়ী উঠিলেন গিয়ে।।
ক্রমেই ঘায়ের ব্যাথা বাড়িতে লাগিল।
কাতরে অশ্বিন বলে ওড়াকান্দি চল।।
তাই শুনি পূর্নচন্দ্র অশ্বিনীকে নিয়ে।
নৌকাযোগে উতরিল আমড়িয়া গিয়ে।।
আমড়িয়া বাস করে শ্রীনীলরতন।
অশ্বিনীর প্রিয় শিষ্য জানে সর্ব্বজন।।
দেখে সে নীলরতন লাগিল কাঁদিতে।
অশ্বিনীকে কোলে করে লইল ঘরেতে।।
যত্ন করি তার নারী ধোয়াল চরণ।
ছলছল আখি দুটি ঝরে দুনয়ন।।
এইভাবে কয়দিন তথায় রহিল।
তাই দেখে পূর্ণচন্দ্র ঘরে ফিরে এল।।
সেই গ্রামে অশ্বিনীর যত ভক্ত ছিল।
একে একে সবে মিলে দেখিতে আসিল।।
দেখিলেন অশ্বিনীর অতি কৃশকায়।
সবে মিলে ভাবিলেন কি হবে উপায়।।
ক্রমেই ঘায়ের ব্যাথা বাড়িতে লাগিল।
অশ্বিনী বলেছে ওড়াকান্দি লয়ে চল।।
সে নীলরতন তাহা শুনিতে পাইয়া।
বড় এক নৌকা আনে জোগাড় করিয়া।।
নৌকায় ছাওনী বেঁধে আসন পাতিল।
অশ্বিনীকে কোলে করে নৌকায় শোয়াল।।
অশ্বিনীর কাছে বসে সে নীলরতন।
নৌকা বেয়ে চলে তারা আর তিনজন।।
নব গোসাই কার্ত্তিক আর বাবুরাম।
অশ্বিনীর প্রিয় ভক্ত সবে গুণধাম।।
হরি হরি বলে সবে তরণী বাহিল।
ওড়াকান্দি ঘাটে গিয়ে তরী ভিড়াইল।।
অন্তরেতে গুরুচাঁদ জানিয়া তখন।
নিজে তাই ঘাটে এসে দিলে দরশন।।
তখনি অশ্বিনী এসে চরণে পড়িল।
চরণ ধরিয়া শেষে কাঁদিতে লাগিল।।
কেঁদে বলে ওগো প্রভু করি নিবেদন।
আমি এবে কি করিব বল প্রাণধন।।
গুরুচাঁদ বলে বাপ শুনরে অশ্বিনী।
এ জগতে চিরদিন বাঁচে কোন প্রাণী।।
এ সংসারে সব মিছে হরিনাম সার।
হরিনামে হয়ে যাবে ভবসিন্ধু পার।।
মিছে কেন চিন্তা কর ওহে বাছাধন।
তোমা সম হরিভক্ত আছে কোন জন।।
সঙ্গে যারা এসেছিল তাহাদের বলে।
অশ্বিনীকে নিয়ে যাও চাঁদসীতে চলে।।
গুরুচাঁদ আজ্ঞামতে তাহাই করিল।
নৌকা বেয়ে কয়জনে সেখানে চলিল।।
সারারাত বেয়ে বেয়ে চাঁদসী পৌছাল।
ভোরবেলা ঘাটে গিয়ে নৌকা ভিড়াইল।।
সেই রাত্রে ডাকতার স্বপনে দেখেছে।
মোর কাছে এক মহামানব এসেছে।।
তার ঘরে পুত্র কন্যা কিছু হয় নাই।
পুত্র হবে তোর ঘরে বলিল গোসাই।।
ভোরবেলা ঘাটে এসে দেখিতে পাইল।
স্বপ্নে দেখা সে মানুষ ঘাটেতে আসিল।।
যত্ন করি অশ্বিনীকে ঘরেতে আনিল।
চরণ ধরিয়া শেষ কাঁদিতে লাগিল।।
কেঁদে বলে ওগো বাবা বলি তব ঠাই।
তব কাছে আসি আজ পুত্র বর চাই।।
স্বপনেতে তোমাকেই দেখিয়াছি আমি।
তব মুখে পুত্র বর দাও আজি তুমি।।
কান্না দেখে বলেছেন অশ্বিনী গোসাই।
তব ঘরে পুত্র হবে বলিলাম তাই।।
সঙ্গে যারা এসেছিল অবাক হইল।
পায়ের ঘায়ের কথা তাহাকে বলিল।।
তাই শুনি ডাকতার কহিল তখন।
মহারত্ন গুণনিধি সাধু শিরমনী।।
ইচ্ছাতে করেছে রোগ আমি ভাল জানি।
তাই শুনে সে অশ্বিনী কহিল তখন।।
মোরে লয়ে চল সবে গুরুর ভবন।
তাই শুনে সবে মিলে নৌকায় তুলিল।।
হরি হরি বলে সবে নৌকা ছেড়ে দিল।
অর্ধপথে গিয়ে সেই অশ্বিনী গোসাই।
সে নীলরতন ধরে ছাড়িলেন হাই।।
হরি বলে সে অশ্বিনী কহিতে লাগিল।
মৃদুস্বরে কহে বাণী আখি ছলছল।।
আমি যদি চলে যাই পৃথিবী ছাড়িয়া।
গুরুপাশে রেখ মোরে যতন করিয়া।।
এত বলি মহারত্ন হরি হরি বলে।
হরিনাম করে আর ভাসে আখি জলে।।
হরি হরি হরি বলে ত্যাজীব জীবন।
বিদ্যুতের মত জ্যোতি উঠিল তখন।।
তাই দেখে সবে মিলে করে হায় হায়।
ব্রহ্মরন্ধ ফেটে গেছে দেখিবারে পায়।।
কেদে কেদে সবে মিলে ছাড়িতেছে হাই।
হেন রত্ন আর মোরা কোথা গিয়ে পাই।।
চলে গেলে ওগো বাবা মোদের ছাড়িয়া।
কেমনে থাকিব মোরা শোক পাসরিয়া।।
এইভাবে কেদে কেদে কাতর হইয়া।
ধীরে ধীরে চলিলেন তরনী বাহিয়া।।
শোক সম্বরিয়া সবে তরণী বাহিল।
নারিকেল বাড়ী এসে উপনীত হল।।
গ্রামবাসী সবে এসে কেদে ছাড়ে হাই।
হেন রত্ন ছেড়ে যাবে মনে ভাবি নাই।।
শোক নিবারণ করি সমাধি করিল।
তারপর গঙ্গাচন্না সংবাদ জানাল।।
সংবাদ পাইয়া সবে কাদিতে লাগিল।
পরিবারসহ কেদে আকুল হইল।।
তারপর সবে মিলে শোক পাসরিয়া।
সৎকাজ করিলেন সকলে মিলিয়া।।
সোনার মানুষ গেল জগৎ ছাড়িয়া।
হরিভক্ত কাঁদে সবে বিরলে বসিয়া।।
তেরশ তেত্রিশ সাল তিশরা আষাঢ়।
বুধবারে মহারত্ন ত্যাজিল সংসার।।
কান্দিয়া বিনোদ বলে বেলা বেশি নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।
******সমাপ্ত******